প্রথম পর্ব
ট্রেকিং করার অভিজ্ঞতা আমার খুব কম। মোটামুটি ট্রেকিং বলতে যা বুঝায় সেটাও করেছি ১০–১১ বছর আগে, বান্দরবানের কয়েকটি পাহাড়ে। যেগুলোর উচ্চতা ১১০০–১২০০ মিটারের মত আর সেটাই ছিল আমার ট্রেকিংয়ের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা। তবে ‘পিচঢালা পথটাকে ভালোবেসে’ এবং নিজের কাজের কারণে প্রতিদিন ২–৩ কিলোমিটার রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আছে। যেটা অজান্তেই সুউচ্চ কোনো পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাসের ভিত গড়ে দিয়েছে আমার মধ্যে।
এই অল্পস্বল্প অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে রওনা দিলাম পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ, আকর্ষণীয় ও কঠিন ট্রেক ‘অন্নপূর্ণা সার্কিটে’ ওঠার। ব্যাগ–ট্যাগ নিয়ে সাতসকালে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ করে সোজা হিমালয় কন্যা নেপালে। পৌঁছেই সোজা চলে গেলাম নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড অফিসে। এখান থেকে নিতে হলো অন্নাপূর্ণা সার্কিটে ট্রেকিং করার অনুমতিপত্র। এর জন্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্ধারিত ফরম পূরণ করে জমা দিতে হলো সঙ্গে প্রবেশ ফি। সার্কভুক্ত দেশ এবং অন্য দেশগুলোর জন্য আলাদা আলাদা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আমরা সমস্ত কিছু জমা দিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে অনুমতিপত্র পেয়ে গেলাম। দুপুরের পর আমাদের নেপালি এক বন্ধুর সহযোগিতায় কিছু ট্রেকিং গিয়ার কিনলাম এবং তার সঙ্গে ট্রেকিং প্ল্যান নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করে নিলাম। আমি প্রথমবার এত উচ্চতায় এবং লম্বা পথে ট্রেকিং করবো শুনে সে শুরুতে আমতা–আমতা করলেও পরে বেশ উৎসাহ দিয়ে আবার দেখা হবে বলে বিদায় নিলো। অধিকাংশ ট্রেকার বেসীশাহার কিংবা জগত থেকে ট্রেকিং শুরু করে বটে। তবে আমরা একসঙ্গে দু’টা ভিন্ন পথ কাভার করবো তাই সিদ্ধান্ত নিলাম চামে থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু করার।
১৪ তারিখ আমাদের পরিকল্পনা ছিলো কাঠমান্ডু থেকে বেসীশাহার হয়ে চামে চলে আসার। কিন্তু যাত্রার প্রথম দিন আমাদের পরিকল্পনা–মাফিক এগোতে পারি নাই। কাঠমান্ডু থেকে বেসীশাহার এসে নেপালের বিখ্যাত ডাল–ভাত খেতে বসে দেখি চামের শেষ জিপ চলে গেলো আমাদের রেখে। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত একটা জিপ পাওয়ার পর যখন যাত্রা শুরু করলাম তখন আমাদের চালক বিনয়ের সুরে বললো, তার গাড়িতে তেল নাই এবং পেট্রোল স্টেশনে যাওয়ার পর দেখলাম নেপালের জাতীয় নির্বাচনের কারণে সেটা বন্ধ আর পুরো বেসীশাহার জুড়ে এটাই একমাত্র পেট্রোল স্টেশন। অনেক অনুরোধ করার পরও যখন চালক তেল পেলো না তখন আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে বেসীশাহারে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাতেই প্ল্যান করলাম পরের দিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা বেসীশাহারে থেকে চামে’র উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন হোটেল রুমের বাইরে এলাম তখন আমার সামনে বিশাল এক পর্বত মাথায় সাদা সাদা বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘শুভ সকাল’ বলার জন্য। জীবনে প্রথমবার এত কাছ থেকে বরফখচিত পর্বত দেখলাম। এই পর্বত দেখতে–দেখতে যাত্রা শুরু করলাম চামে’র দিকে। বেসীশাহার থেকে চামে পর্যন্ত রাস্তাটা আপনাকে গন্তব্য সম্পর্কে নতুন ধারণা দেবে। ভাঙাচোরা ছোট সরু রাস্তা এবং পাহাড়ের খাদ প্রথমে আপনাকে ভয় পাইয়ে দিলেও রাস্তার পাশ দিয়ে বরফ গলা ঝর্ণা’র পানি, নিচে খাদ দিয়ে বয়ে চলা নদী সে–সঙ্গে আশেপাশের উঁচু–উঁচু পর্বতের মাথাভর্তি বরফ আপনাকে সুন্দরের নতুন সংজ্ঞা খুঁজতে বাধ্য করাবে। ভয়মিশ্রিত অপূর্ব সুন্দর ৫ ঘণ্টা যাত্রার পর প্রায় দুপুর ২টার দিকে আমরা চামে (২৬৭০ মিটার) পৌঁছালাম। সেখানে মধ্যাহ্নভোজনের পর সিদ্ধান্ত নিলাম ঐদিনই পিসাংয়ের পথে ট্রেকিং শুরু করবো। ম্যাপ এবং দূরত্ব দেখলাম। এই পথ যেতে আমাদের মোট ৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের মতোন হাঁটতে হবে। ১৪–১৫ কেজি ওজনের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মূল ট্রেকিং শুরু করলাম। যত সামনে যাচ্ছি তত বরফগুলো আমাদের কাছে চলে আসছে। প্রথম ৩০ মিনিট হাঁটার পর আমাদের সামনে হাজির অন্নপূর্ণা–১। যার গল্প শুনেছি, ছবি দেখেছি অসংখ্যবার। আর এখন আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তার রূপে মুগ্ধ হচ্ছি। বলা যায়, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। পাক্কা তিন ঘণ্টা হাঁটার পর পর্বতজুড়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সঙ্গে ঠাণ্ডার মাত্রাটাও বাড়ছে। তখনো পিসাং পৌঁছাতে ২–৩ ঘণ্টা পথ বাকি। সন্ধ্যার তারাদের সঙ্গে নিয়ে ঠাণ্ডার মধ্যে ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর বুঝতে পারলাম, আজকে আর পিসাং পৌঁছাতে পারবো না। নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড থেকে দেওয়া ম্যাপে দেখলাম, পিসাং জায়গাটার আগে আরেকটা ছোট জায়গা আছে। যেটার নাম সম্ভবত ‘ডোকর পোকরা’। সিদ্ধান্ত নিলাম রাত কাটাবো সেখানে। ঐ জায়গায় পৌঁছে তাড়াতাড়ি একটা টি–হাউজরুম ঠিক করলাম। এই অন্নপূর্ণা সার্কিট সারা পৃথিবীর ট্রেকারদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, পুরো ট্রেকিং পথজুড়ে অনেক টি–হাউজ রয়েছে যার ফলে আপনাকে এখানে ট্যান্টে (তাঁবু) থাকতে হবে না। যখনই হাঁটা বন্ধ করে রুমে ঢুকলাম, বুঝলাম ঠাণ্ডা কী জিনিস। তাপমাত্রা চেক করলাম। দেখে চোখ মোটামুটি কপালে উঠার মত পরিস্থিতি। শূন্য (০) ডিগ্রি সেলসিয়াস! আর এদিকে কম তাপমাত্রার কারণে আমার ফোন এবং পাওয়ার ব্যাংক দুইটাই বন্ধ হয়ে গেছে। টি–হাউজে রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি সমস্ত গরম কাপড় নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ট্রেকিংয়ের প্রথম রাতটা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে পার করলাম।
ভোরে টি হাউজে হৈচৈ শুনে ঘুম ভাঙলো। রুমের বাইরে এসে দেখি, অনেক ট্রেকার ব্যাগ–ট্যাগ নিয়ে তাদের ট্রেকিং শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাতে এই টি–হাউজে আসার কারণে খুব বেশি চারপাশের অবস্থা বুঝতে পারিনি। সকাল– সকাল বুঝলাম কেন এই পথ এত জনপ্রিয় চারপাশে সাদা–সাদা বরফে ঢাকা পর্বতমালার মাঝখানে ছোট্ট এই টি–হাউজ। এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে, আমি হারুকি মুরাকামির কোনো গল্পের মধ্যে ডুবে আছি। এই দৃশ্যকে সাথে নিয়ে টি–হাউজটাকে পেছনে রেখে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। লম্বা পথ ধরে আজকে একটু তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু হলো আমাদের। যাত্রার প্রথম ঘণ্টা অনায়াসে পার করে পৌঁছালাম লোয়ার পিসাং–এ। সকালের নাস্তা করার জন্য একটা টি–হাউজে ঢুকলাম। তাদের খাবারের দাম দেখে আমাদের দুই বন্ধুর আর ইচ্ছেই হলো না নাস্তা করার । খালি পেট প্রিয়তমার সুন্দর হাসিও মেজাজ খারাপ করে দেয়, এটা ভেবে দুইটা ডিম ৩০০ রুপি দিয়ে নিলাম। আর স্থানীয় বাগানের আপেল খেয়েদেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। সকাল সকাল টি–হাউজ থেকে বের হওয়ার সময় অনেক ট্রেকার দেখলেও যে–পথ দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছি সে পথে খুব বেশী ট্রেকার না দেখে একটু অবাক লাগছিল। লোয়ার পিসাং এলাকার লোকজন থেকে জিজ্ঞাস করলাম, মূল ট্রেকিং পথ কোনটা? তারা জানাল, আমরা যে–পথ দিয়ে হাঁটছি সেটা মূলত গাড়ি চলাচলের পথ আর ট্রেকিং পথটা অন্যদিকে। তাদের দেখানো পথ দিয়ে শুরু করলাম ট্রেকিং। এই পথ দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর অন্য ট্রেকারদেরও দেখা পেলাম। এই পথ দিয়ে যাত্রা শুরু করার পর বুঝলাম, আমার মত অনভিজ্ঞ লোকদের জন্য ট্রেকিং কতটা চ্যালেঞ্জের। ট্রেকিংয়ের চিন্তাভাবনার পর থেকে ছোট–ছোট নানা পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি নিয়েছি। কয়েকজন অভিজ্ঞদের সাথে আলাপ করেছি। এই প্রস্তুতি নিয়ে ট্রেকিংয়ের প্রথম দিনটা মোটামুটি ভাবে পার করে দেওয়ার পর মনে হলো, প্রস্তুতি আমার যথাযথ আছে। দ্বিতীয় দিন এসে বুঝলাম, আমার প্রস্তুতি এবং ধারণা দুইটাতেই ভুল আছে । লোয়ার পিসাং থেকে যখন আমরা মূল পথ দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম তখন উচ্চতা যেমন বাড়ছে তার সাথে সাথে প্রচন্ড বাতাস মনে করিয়ে দিচ্ছিল যমদূতকে । আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমরা যত উপরে উঠছি ততবেশী বাতাসের গতিও বাড়ছে । আসলে আমার এই ট্রেকিংয়ের জন্য নেওয়া পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি কোনটাতেই এই প্রচন্ড বাতাস সম্পর্কে প্ল্যানে ছিলো না। একটু ভাবেন তো, ৩–৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ১২ হাজার ফুট উপরে প্রচন্ড বাতাসের মধ্যে ১৪–১৫ কেজি ওজনের একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সমুদ্র পাড় থেকে আসা একটা ছেলে হাঁটছে! তার কী অবস্থা হতে পারে? তার উপর যদি এই প্রচন্ড বাতাস নিয়ে তার কোনো পূর্বধারণা নাই থাকে! এক পর্যায়ে ভাবতে শুরু করলাম আমি পারবো না। কিন্তু আমার বন্ধু, অন্য ট্রেকার এবং বিশাল বিশাল পর্বতের উৎসাহে ‘হারার আগে হার নই’ এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে আস্তে আস্তে পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। ঘণ্টা তিনেক পরে মোটামুটি চলনসই পরিস্থিতিতে চলে আসলাম। তারপরও বাতাসে মাঝে মাঝে তুলার মত উড়ে খাদ পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলাফল, আমরা যথাযথ সময়ে মানাং পৌঁছাতে পারলাম না । তবে যে–গ্রামটাতে এসে পৌঁছালাম সেটা আমার দেখা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম । মানাংয়ের (৩৫৬০ মিটার) চেয়ে ১০০ মিটার বেশি উঁচুতে অবস্থিতি এনগাওয়াল (ngawal) গ্রামটি । বেশ বড়সড় গ্রাম হলেও মানুষের আনাগোনা একেবারে কম। পর্বতগুলো একটু দূরে সরে গিয়ে চারপাশে অবস্থান করছে। যার ফলে গ্রামের লোকজন চাষবাস করার জন্য বেশকিছু জমি পেয়েছে। বিশাল গেইট দিয়ে যখন আমরা গ্রামটিতে প্রবেশ করি তখন প্রায় বিকেল। সূর্যটা পাহাড়ের পেছনে লুকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে আর গ্রামের জমি জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্যা ইয়েক। এ–যেন কোনো শিল্পীর আঁকা কল্পিত গ্রাম। গ্রামটির যে টি–হাউজে উঠেছি তার মালিকও ছিলেন অসাধারণ। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তার কথা বলার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। তার ভাঙা–ভাঙা ইংরেজিতে গ্রামের লোকজনের জীবিকাসহ নানা বিষয়ে আলাপ হলো। এই অন্নপূর্ণা সার্কেটে অসংখ্য ইউরোপিয়ান ট্রেকার আসার কারণে অধিকাংশ টি–হাউজের মালিক চলনসই ইংরেজি জানে। বাঙালিদের আড্ডাবাজ হিসেবে বেশ সুনাম আছে। তারা আড্ডার মধ্যেই নাকি পৃথিবীর বহু অসাধ্য কাজ সাধন করে ফেলে। ফলে অপূর্ব সুন্দর এই গ্রামের সন্ধ্যার আড্ডাটা আমার সারাদিনের ক্লান্তিটাকে নিমিষে গায়েব করে দিল। সকালে টি–হাউজের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বরফ গলা ছোট্ট ঝিরির শব্দে ঘুম ভাঙল।