রবীন্দ্রনাথ তার ‘প্রশ্ন’ কবিতায় হৃদয়ছোঁয়া আকুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’– আমরা এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই প্রত্যক্ষ করেছি রবীন্দ্রনাথের হৃদয় বেদনার যথার্থতা। ইরাকে মরণঘাতি অস্ত্রের মওজুদ আছে এমন এক মিথ্যার বেশাতীতে আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য ইরাক আক্রমণ করে এবং সে দেশের নেতা সাদ্দাম হোসেন সহ লক্ষ মানুষ হত্যা করে। এর পর লিবিয়া পুরা আরব বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রাণচঞ্চল অর্থনীতির দেশ অনেকটা বিনা কারণে একই পশ্চিমা জোট এই দেশটি আক্রমণ করে সেদেশের নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফীসহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে দেশটিকে ধ্বংসস্ত্তূপে পরিনত করে, আফগানিস্তানে চালানো বর্বরতা পৃথিবী দেখেছে অসহায়ত্বের অঞ্জন পরে। পাশ্চত্যের ইন্ধনে দক্ষিণ ইয়েমেনে লক্ষ লক্ষ ইয়ামিনিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, মিশরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরশিকে ক্ষমতাচ্যুতির মাধ্যমে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। বিশ্বব্যাপী সংঘটিত এসব অপরাধের কোনটিরই বিচার হয়নি। নাগাসাকি হিরোশিমার অমন পাপের প্রায়শ্চিত্তও কাউকে করতে হয়নি। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নুরেমবার্গ আদালতে শুধু কিছু নাৎসীর বিচার হয়েছিল। মিত্র শক্তির কারো বিচার হয়নি। বিচার হীনতার এ সংস্কৃতি এখনো চলছে। এরই রেশ ধরে সম্প্রতি আমেরিকান এক বর্বর কংগ্রেসম্যান ওয়েলবার্গ গাজায় দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার জন্য আনবিক বোমা ব্যবহারের বিষয় বিবেচনার কথা বলেছেন। কী উদ্ধৃত্ত তথাকথিত সভ্যতাদর্পীদের। এজন্যই এ লেখাটির শিরোনাম বিচারের দুরাশা। ১ এপ্রিল ২০২৪ এ লেখাটি যখন লিখতে বসেছি সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরার রাতের খবরে ভয়াবহ একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়। সংবাদটি হল গাজার আলসিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ৩০০ (তিনশ) এর উপর ফিলিস্তিনিকে পিছমোরা বেঁধে গর্তে ফেলা হয় তারপর জীবন্ত সেইসব হতভাগ্য মানুষগুলির উপর বুলডোজার চালিয়ে তাদের সমাধিস্থ করা হয়।
২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্ব–যুদ্ধে ইহুদিদের সমর্থন লাভের আশায় বৃটিশ সরকার তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বালফোরকে দিয়ে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি গড়ার ঘোষণা দেয়। সেই থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ভূ–রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক হেন কোন ষড়যন্ত্র বা কূটকৌশল বাদ নেই যা ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে প্রতিষ্ঠা আর প্যালেস্টাইন থেকে প্যালেস্টাইনীদের উৎখাত করতে গ্রহণ করেনি। এরই ফলশ্রুতি যুগ যুগ ধরে প্যালেস্টাইনী জনগণের উপর অমানবিক আচরণ, নির্মম অত্যাচার, স্বীয় ভূমি থেকে ক্রমাগত উৎখাত এবং ঐ সমস্ত উচ্ছেদকৃত ভূমিতে ইহুদিদের পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে জড়ো করে বসতি স্থাপন।
হামাস ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের প্রত্যুষে ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’ নাম দিয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরে আক্রমণ শুরু করে। এক অডিও বার্তার মাধ্যমে হামাস কমান্ডার মোহাম্মদ দায়েফ ঘোষণা করেন ‘এ অভিযান পৃথিবীর সর্বশেষ দখলদারিত্ব অবসানের লক্ষ্যে’। এই হামলায় ৩৭৩ জন ইসরাইলী সেনা সহ ১১৩৯ জন নিহত হন। জিম্মি হিসাবে আটক হন ২৫৪ জন। এ প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনসহ নানা অভিধায় অভিষিক্ত করে গাজার উপর ইসরাইলী বর্ববর আক্রমণকে উৎসাহিত করে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্লিংকেন স্বশরীরে তেল আবিব’এ গিয়ে হাজির হন। আরো এক ডাং বাড়িয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অস্ত্র বোঝাই যুদ্ধ বিমানে গিয়ে হাজির হন তেল আবিবে। এরা এ উৎসাহবোধ দেখাতে কার্পণ্য না দেখানোর কারণ অতীতের এবং বর্তমান বিশ্বের চলমান বিচারহীনতা। অথচ এই সভ্যতাদর্পী নেতারা বিগত সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলীদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া অসংখ্য গণহত্যা, নিজেদের জমি জিরাত থেকে উৎখাত হয়ে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্ত্তুতে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বা তা করতে গরজও বোধ করেনি।
সম্প্রতি পশ্চিমা সভ্যতাদর্পী মানবতার ধ্বজাধারীদের গাজায় বেপরোয়া গণহত্যায় নীরব ভূমিকার বিপরীতে দাঁড়িয়েছে আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপন করেছে। কখন একটি জাতির বিরুদ্ধে বা একটি অঞ্চলে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। আমরা এবিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করে দেখব। জাতিসংঘ সনদ বা বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী গণহত্যা কী এবং কখন এটি সংঘটিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে?
গণহত্যার পটভূমি এবং ব্যাপ্তি বিবেচনায় প্রায় সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা অধিক মাত্রায় হয়ে থাকে। ব্যক্তির উপর গণহত্যার দায় চাপিয়ে অনেক সময় আমরা রাষ্ট্রকে আড়ালে রাখার অবকাশ সৃষ্টি করি। এটি গণহত্যার মত একটি মানবতা বিরোধী অপরাধে রাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দেওয়ার মত। গণহত্যা সংক্রান্ত কনভেনশনে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখানে যে কোনও বিচ্যুতিতে রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। ইসরাইল ক্রমাগত বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনিদের উপর একের পর এক মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। এ সমস্ত অপরাধ কোনও ব্যক্তির দ্ধারা সংঘটিত হয়নি। সংঘটিত এ সমস্ত অপরাধের উদগাতা– উদ্যোগী এবং কার্যকর করেছে রাষ্ট্র। যেমন ফিলিস্তিনিদের চলাচলের স্বাধীনতা হরণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি থেকে বঞ্চিতকরণ রাষ্ট্রের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালের গৃহীত ২৬০ এ (!) নাম্বার প্রস্তাব Convention of the Prevention and Punishment of the Crime Genocide হল আই সি জে ’ প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। অন্যদিকে আই সি সি প্রতিষ্ঠার মূল ধারণা বিশ্ব–সম্প্রদায়ের কাছে জন্ম নেয় দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধকালীন সংঘটিত ন্যাৎসী জার্মানীর যুদ্ধ অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ আদালত থেকে।
Genocide শব্দটি গ্রীক এবং ল্যাটিন এ দুটি ভাষার সম্মিলন থেকে গঠিত বা উৎপত্তি। এ সম্মিলন বা উৎপত্তিটি ঘটান রাফায়েল লেমকিন, ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তার বই Axis Rule Occupied Europe এ Genocide শব্দটি ব্যবহার করেন। গ্রীক Genos (race/people) গণ এবং ল্যাটিন cide (act of killing) হত্যা. এই Genos (race/people) গণ এবং ল্যাটিন cide (act of killing) হত্যা থেকে Genocide শব্দ।
১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ঘোষিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সনদে গণহত্যাকে বর্ণনা করতে আর্টিকেল ৬ এ বলা হয়েছে act is committed with intend to destroy এবং নিম্নের যে কোনও একটি সংঘটিত হলে তাকে গণহত্যা হিসাবে অভিহিত করার কথা বলা হয়েছে–
ক। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা। খ। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের শারীরিক এবং মানসিক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। গ। পরিকল্পিতভাবে কোনও গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাদের জীবনে আঘাত হানা। ঘ। এমন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ যা ঐ গোষ্ঠীর জন্ম নিরোধ করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। ঙ। জোর পূর্বক এক জনগোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা গণহত্যা বিষয়ক অপরাধ এবং শাস্তি সংক্রান্ত আর্টিকেল ৭ বলা হয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হবে যদি ঐ অপরাধ Committed as part of wide spread or systematic attack directed against any civilian population, with knowledge of attack. অর্থাৎ কোনও একটি নির্দিষ্ট বেসামরিক নাগরিক গোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে যে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আর্টিকেল ৭ এ নিম্নোক্ত ১৬ টি অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে–
হত্যা, বিনাশ করা, দাসত্ব নিগড়ে আবদ্ধ করা, উচ্ছেদ পূর্বক জোর করে অন্যস্থানে প্রেরণ, অন্তরীণ রাখা অথবা এমন কিছু করা যার মাধ্যমে চলাচলের স্বাধীনতা রহিত হয়, নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোর পূর্বক পতিতা বৃত্তিতে নিয়োগ, বল পূর্বক গর্ভধারণ করানো, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, নৃশংস যৌন আচরণ, নিপড়ন– নিগৃহীত করণ, গুম করা, বর্ণবৈষম্য, অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আর্টিকেল ৮ এ স্বশস্ত্র সংঘাতকালীন নিম্নোক্ত ১১ টি বিষয় সংঘটিত হলে তাকে যুদ্ধ অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে–
পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, অমানবিক আচরণ, মানুষের জীবনের উপর জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো, ইচ্ছাকৃত মানুষের উপর সীমাহীন দুর্ভোগ সৃষ্টি করা, বে আইনী সম্পদের ধ্বংস সাধন এবং বাজেয়াপ্তকরণ, শক্র শিবিরে জোর পূর্বক শ্রম দানে বাধ্য করা, সু–বিচার থেকে বঞ্চিত করা, বে আইনী অন্তরীণ রাখা, জিম্মি করা।
লেমকিন গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে ‘সাধারণত একটি জাতি গোষ্ঠীর সব মানুষকে একসাথে হত্যা বা ধ্বংস করলেই যে শুধু গণহত্যা হয় তা নয়। বরং একটি জাতি গোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের সমন্বিত পরিকল্পনায় ঐ জাতি গোষ্ঠীকে বিনাশ করাও গণহত্যা। বিনাশের এই লক্ষ্যে পরিকল্পনার মধ্যে হতে পারে ঐ জাতি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, তাদের ভাষা – সংস্কৃতি, জাতীয় আবেগ অনুভূতি, র্ধম, অর্থনীতি ইত্যাদির উপর আঘাত/ ধ্বংস করে দেওয়া, ব্যক্তির তথা একটি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য, তার লালিত গৌরব এমনকি জীবনের উপর আঘাত করে তা ধ্বংস করাও গণহত্যা।
জাতিসংঘ জেনোসাইড কনভেনশন বা ১৯৪৪ সালে রচিত লেমকিনের Axis Rule Occupied Europe যা পরবর্তীতে গণহত্যা বিষয়ক সমস্ত আইন প্রণয়নে অন্যতম সহায়ক গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। এ সবের আলোকে গাজায় বর্তমানে ইসরাইল এবং তার দোসররা নৃশংস গণহত্যায় শুধু নয় তার গণহত্যার নির্মম নিষ্ঠুর এক উৎসবে মেতেছে। এসব দেখে শুনে আবারো রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন কবিতার সেই অন্তর বিদীর্ণ করা এ প্রশ্ন তুলছি –
‘তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের করিয়াছ ক্ষমা বাসিয়াছ ভাল’?
লেখক: প্রবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক