ঈদ উপলক্ষে কাঠের বাক্সবন্দি হয়ে স্পিডবোট এ বাড়ি যাচ্ছেন এক লাশ, সম্ভবত প্রবাসীর। আজ দেখলাম, প্রায়শই দেখি। সন্দ্বীপবাসীর জন্য নতুন কিছু না। তবে বাড়ি যেতে গিয়েও অনেকে মরে লাশ হয়ে যায়। আজ সেই ব্যাপারে বলি।
সন্দ্বীপবাসীর আজীবনের দুঃখ এই যাতায়াত ব্যবস্থা। কোনোদিনও এই দুঃখ ঘুচবে কিনা জানিনা।
গত সপ্তাহে এক লোক শীপ থেকে ঘাটে পারাপারের যে ছোট নৌকা ওটাতে নামার সময় ঢেউ এর তোড়ে নৌকা সরে যায় আর লোকটা ঝুলে থাকে শীপের সামনে যে একটা চাকার মত বেঁধে রাখা ওটার উপরে, যেটাতে পা দিয়ে উঠানামা করে সেই চাকা ধরে।
মাত্র ৮০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ সন্দ্বীপ। শুধুমাত্র এই সন্দ্বীপ উপজেলা থেকেই দেশের ১১ শতাংশ বা তার বেশি রেমিট্যান্স আসে। কোনো উপজেলা হিসেবে বাংলাদেশে এটা সর্বোচ্চ। তাও কেন এই দুর্ভোগ? এই দুর্ভাগ্য? উত্তর – জানা নেই! যারা চাকরিসূত্রে সন্দ্বীপ অবস্থান করেন বা থাকেন, তারা নিজেরাই জানেন না আসতে–যেতে পারবেন কিনা। যতক্ষণ তারা ঘাটে না পৌঁছেন, জানেন ই না সমুদ্রের অবস্থা কি?
কুমিরা ঘাট থেকে সন্দ্বীপ গুপ্তছড়া ঘাট এর দূরত্ব ১৮ নটিকাল মাইল, উত্তাল সমুদ্রের মাঝখানে কোনো কুলই দেখা যায়না। স্পিডবোট এ ২৫–৩৫ মিনিট, শীপে প্রায় দেড় ঘন্টা। সেটাও ব্যাপার না। ব্যাপার হল, কখন সমুদ্র শান্ত আর কখন উত্তাল তা কেউ জানে না। এতটুকু সবাই জানেন, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সমুদ্র উত্তাল থাকার সম্ভাবনা কম থাকে। সে সময় শীতকাল। সমুদ্রে মধুর সময়। তবে শীতকালের বিড়ম্বনা – কুয়াশা, কুয়াশার সময় প্রথমত, যখন কিছু দেখা যায়না তখন কোনো নৌ–যান, মূলত স্পীডবোট ছাড়েনা। অনেক সময় সকাল ১০টা পেরিয়ে যায়, যা অনেকের জন্যেই বিড়ম্বনার কারণ হয়। দ্বিতীয়ত, ঘাটে যখন কুয়াশা ছিলনা স্পিডবোট ছাড়ল, কিন্তু মাঝসাগরে কুয়াশা –এবার দিকশূন্য সবাই! অনেক দিকে ঘুরে তারপর অনেক সময় ব্যয় করে পৌঁছে যায় নৌ–যান তাও ঘাটে– আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী।
কিন্তু সমুদ্র যখন উত্তাল, তা বছরের বেশিরভাগ সময়েই, তখন উঠানামা করতে গিয়ে কতজনের যে কতরকম দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় সেটার হিসাব আছে কিনা আমার জানা নাই। শীপ নাকি তখন তুলনামূলক সেইফ! অথচ শীপে উঠতে নামতে সবচেয়ে কষ্ট, আপনি একা একটা ব্যাগ কাঁধে তাও এই যাত্রা বাঁচলেন, কিন্তু সাথে পরিবার, বাচ্চা–কাচ্চা, একগাদা ব্যাগ লাগেজ তখন কি বাড়ি যাবেন না সোজা কবরে যাবেন! আল্লাহই ভালো বলতে পারেন।
আর স্পীডবোট এ চলাচল সেইফ না, এই স্পীডবোটগুলো আদৌ সী– ক্যাপাবল কিনা তা নিয়েই সন্দেহ। আর লাইফ জ্যাকেট যেগুলো দেয় সেগুলো তো কোনো সেইফটি দিবেনা সবাই জানি। কেউ কেউ পার্সোনাল লাইফ জ্যাকেট নেন। কিন্তু সমুদ্রের মধ্যিখানে ঢেউ আপনাকে আপনার পার্সোনাল লাইফ জ্যাকেট সহ কোন দেশে নিয়ে যাবে সেটাও আপনি জানেন না। খুব ইন্টারেস্টিং!
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, যখন শীতকাল, খুব মধুর ওয়েদার সমুদ্রে, মানে খুব মজা! পিকনিক! সে মধুর ওয়েদারে বিভিন্ন বড় বড় কর্মকর্তারা সন্দ্বীপ আসেন। আসার সময় স্পীডবোটে উঠেই একটা সেলফি তোলেন। প্রমাণ– আমি সন্দ্বীপ যাচ্ছি। এটা তাঁদের অন্যতম লাইফটাইম এচিভমেন্ট বৈকি।
আর সমুদ্রের জোয়ার ভাটার খেলার সাথে নৌ–যান কোনদিকে ভিড়বে তার একটা সম্পর্ক তো আছেই। ভাটার সময় আপনি সন্দ্বীপ পৌঁছে একটা কাঠের ব্রিজ দেখতে পান, যেটা জোয়ারের সময় বেমালুম গায়েব হয়ে যায়! তখন ঘাটে নামতে বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের খুব কষ্ট হয়। দেখার কে আছে! পরিশেষে, যারা রেগুলার যাতায়াত করে তাদের কষ্ট দেখেও না দেখা একটা আর্ট। সেটাতে পুরো দেশবাসী আর্টিস্ট। আমরা সবাই আর্টিস্ট।
আর্টিস্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে যাতায়াত করব এরপর ভুলে যাব সেই উত্তাল সমুদ্রে ভয়াবহ যাত্রার কথা। সবাই ভুলে যায়… মনে রাখে শুধু সন্দ্বীপবাসী, যারা বিকাল ৫টার পর পুরো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! আর কোনো নৌ–যান যে ছাড়ে না বিকেল ৫টার পর! আমার এবং মজলুম সন্দ্বীপবাসীর পক্ষ থেকে সবাইকে অগ্রীম বাড়ি ফেরার শুভেচ্ছা।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, মেটার্নাল, চাইল্ড হ্যালথ এন্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং,
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম।