রাঙ্গুনিয়ায় অবৈধ চাঁদের গাড়ির (জিপ) বেপরোয়া গতির কারণে নিত্য ঘটছে দুর্ঘটনা। অনুমোদনহীন এসব গাড়ি ইটভাটায় অবৈধ জ্বালানি কাঠ ও ইট–বালি পরিবহনের কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়। যারা এসব গাড়ির চালক তাদের অধিকাংশই অদক্ষ এবং অল্প বয়সী। ফলে এসব গাড়ির কারণে নিত্য নানা দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও অঙ্গহানির মতো ঘটনা ঘটে চলছে। শুধুমাত্র এ বছরেই দ্রুতগামী জিপের ধাক্কায় রাঙ্গুনিয়ায় ৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। কিন্তু এরপরও সড়কে এসব গাড়ি চলাচল বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। এতে ক্ষোভে ফুসছে সাধারণ মানুষ।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পারুয়া ডিসি সড়কের উত্তর ঘাটচেক এলাকায় জ্বালানি কাঠভর্তি বেশকিছু চাঁদের গাড়ি আটকে রাখেন বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ। সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা এসব গাড়ির কারণে নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসময় ঘটনাস্থলে আসা পৌর কাউন্সিলর আবুল কাশেম বলেন, গাড়িগুলো অনেক উঁচু করে জ্বালানি কাঠ নিয়ে যাওয়ার সময় দীর্ঘদিন ধরে ডিস লাইন, বৈদ্যুতিক তার, ওয়াফাই তার ছিড়ে ফেলছে। আজও (মঙ্গলবার) একটি গাড়ি তার ছিড়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসী গাড়িটিকে দাঁড়াতে বললে তারা অগ্রাহ্য করে তাদের চাপা দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ভাগ্যক্রমে এলাকার মানুষ রক্ষা পেয়েছে। এভাবে সড়কে গাড়িগুলো কাউকে পরোয়া না করেই বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। বিষয়টি আমি পুলিশকে জানিয়েছি।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, রাঙ্গুনিয়ায় সড়কগুলোতে প্রতিদিন এক হাজার চাঁদের গাড়ি চলাচল করে। এসব গাড়ির চালকদের নেই কোনো লাইসেন্স, নেই সড়ক সম্পর্কে সচেতনতা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকের সংখ্যাও কম নয়। মূলত ইট আর কাঠ বোঝাইয়ের কাজে এই গাড়ি ব্যবহৃত হয়। ইট ভাটার মৌসুমে এসব গাড়ি অবৈধ জ্বালানি কাঠ নিতেই বেশি চলতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় লাইসেন্স বিহীন যে কেউ চালাচ্ছে এসব গাড়ি। ফলে নিত্য দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। সর্বশেষ গত ২৩ অক্টোবর সড়ক উপজেলার পদুয়া বটতল এলাকায় দ্রুতগামী চাঁদের গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান পদুয়া যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুন্নবী (৪০) ও বান্দরবান সদর উপজেলার মো. হেলাল উদ্দিন (৩৮) নামে একজন ইউপি সদস্য। এর আগে চলতি বছরে একই কায়দায় প্রাণ হারান মোটরসাইকেল আরোহী পদুয়া ছাত্রলীগ নেতা ওবাইদুল হক জাহেদ (২৫)।
এর আগে ২১ জানুয়ারি রাঙামাটি সড়কের রাঙ্গুনিয়ার কাউখালী রাস্তার মাথা এলাকায় বেপরোয়া চাঁদের গাড়ির সাথে মোটর সাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. মিজান (২২) নামে এক বাইক আরোহী নিহত ও মো. আবদুল্লাহ (১৮) নামে আরও এক আরোহী আহত হন। এর দুদিন আগে ১৯ জানুয়ারি পদুয়া ইউনিয়নের রাজারহাট মহাজন পাড়া এলাকায় দুর্ঘটনায় মো. রাজা মিয়া (৫২) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়। গত বছরের ২ অক্টোবর দ্রুতগামী চাঁদের গাড়ির সাথে শ্যামলী পরিবহন বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে স্যং প্রো মারমা (২৫) নামে এক চাঁদের গাড়ির হেলপারের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় বাসের অন্তত ১৫ জন যাত্রী। ১২ ফেব্রুয়ারি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের সাহেবনগর এলাকায় সড়কে বেপরোয়া ইটবোঝায় চাঁদের গাড়ির চাপায় মো. মাসুদ (৪০) নামের এক ব্যবসায়ীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৯ সালে। ভোরের দিকে ইটভাটা শ্রমিকেরা রাস্তার পাশে অস্থায়ী ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। একটি চাঁদের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওই ঘরে ঢুকে পড়ে চাপা দেয় তাদের। চারজনই মারা যান ঘটনাস্থলে। এর কয়েক মাস আগে উপজেলা সদর থেকে সিএনজি অটোরিঙায় চড়ে চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান যাওয়ার পথে আধুরপাড়া এলাকায় চাঁদের গাড়ির চাপায় যাত্রীবাহী সিএনজি অটোরিঙার যাত্রী মোহাম্মদ শাকিল (২২) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই অনেকটা প্রকাশ্যে চলাচল করে গাড়িগুলো। তাই প্রশাসন সাময়িক গাড়িগুলোকে আটক করলেও পরক্ষণেই তা আবার সড়কে চলতে দেখা যায়। গাড়িগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্টদের। বরং প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধে চষে বেড়াচ্ছে এসব গাড়ি। চোখে দেখলেও এদের থামানোর যেন কেউ নেই।
এই বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি চন্দন কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, ঘাটচেক এলাকায় জব্দকৃত চাঁদের গাড়িগুলোর বিষয়ে পুলিশ যাওয়ার আগেই তারা নিজেরা কথা বলে সমাধান করেছে। চাঁদের গাড়ির চলাচল বন্ধে বিভিন্ন সময় নানা অভিযান চালিয়ে থাকি। তারপরও এসব অবৈধ গাড়ি স্থায়ীভাবে বন্ধে আমরা পদক্ষেপ নিব।