ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকানদের বলেছিলেন কোভিড–১৯ নিয়ে বেশি চিন্তা না করতে। কারণ, তার মতে, ‘করোনাভাইরাসে আসলে প্রায় কারোই কিছু হয় না, কেবল বয়স্ক এবং হৃদরোগীদের ছাড়া।‘ একথা বলার এক সপ্তাহের মধ্যেই ট্রাম্প এবং ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হলেন। বৃহস্পতিবার রাতে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকালে) এক টুইটে ট্রাম্প নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হোপ হিক্সের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে দিয়েছিলেন ট্রাম্প ও মেলানিয়া। সেই পরীক্ষার ফল ‘পজিটিভ’ আসার খবর দেন ট্রাম্প। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্কদের ঝুঁকিই সবচেয়ে বেশি। ৭৪ বছর বয়সী ট্রাম্প সেই বয়স শ্রেণিতেই পড়েছেন। আর মেলানিয়ার বয়স ৫০ বছর।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার মাঝখানে, যখন কীনা ভোটের বাকি আর মাত্র ৩২ দিন, তখন এই খবরটা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে। এই খবরের সাথে সাথেই বিশ্বের শেয়ারবাজারে বড় প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কারণ এটি শুধু বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের ব্যাপারেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা যে নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেল, এটা নিয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই।
বিবিসি লিখেছে, এটা যে কী মারাত্মক এক ঘটনা, তার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এখন কোয়ারেনটিনে থাকতে হবে। চিকিৎসা নিতে হবে। তার নির্বাচনী সমাবেশে যাওয়ার কোন সুযোগই আর নেই। দুই সপ্তাহের মধ্যে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর যে দ্বিতীয় টেলিভিশন বিতর্ক হওয়ার কথা, সেটি আদৌ হবে কি না, তা প্রশ্নবিদ্ধ।
সিএনএন লিখেছে, কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের এরকম গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে ট্রাম্পের এই অসুস্থতা নতুন সঙ্কটের ঝুঁকি তৈরি করল।
ট্রাম্পের চিকিৎসক শন কনলি এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি দুজনেই আপাতত ভালো আছেন। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজে নিজেদের ঘরেই থাকার পরিকল্পনা করেছেন তারা।
ভোট সামনে রেখে গত কয়েক সপ্তাহে নিয়মিতভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সফরে যাচ্ছিলেন ট্রাম্প। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেই তিনি হাজারো মানুষের ভিড়ের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে যোগ দিচ্ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেভাবে এই মহামারী সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা– দুদিক দিয়েই বিশ্বে এখন সবার উপরে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে এ পর্যন্ত ৭২ লাখের বেশি মানুষের কোভিড–১৯ ধরা পড়েছে। দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ট্রাম্প দিনের পর দিন করোনাভাইরাসের এই সঙ্কটকে খাটো করে দেখিয়ে আসছিলেন। বিজ্ঞানীদের কথায় পাত্তা না দিয়ে প্রায়ই তিনি বলছিলেন, এ ভাইরাস মিলিয়ে যাবে। বৃহস্পতিবারও এক ভোজসভায় তিনি বলেন, শিগগিরই মহামারীর অবসান হতে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন। সংক্রমণ এড়াতে চিকিৎসকরা যেখানে মাস্ক ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে মাস্ক পরতে অনাগ্রহ দেখিয়ে এসেছেন, এমনকি যারা মাস্ক পরছেন, তাদের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। এখন ট্রাম্পের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার এই খবর যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্ব সঙ্কটের ঝুঁকি তৈরি করল এবং মহামারীর সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুললো বলে মন্তব্য করা হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে। পত্রিকাটি লিখেছে, ৩ নভেম্বর ভোট সামনে রেখে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প এখন আর সশরীরে নির্বাচনী প্রচারে থাকতে পারবেন না। হোয়াইট হাউজে কতদিন তাকে আইসোলেশনে থাকতে হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর তার অসুস্থতা যদি বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই জটিলতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। তিনি দেশ পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়লে কী ঘটতে পারে ু এ প্রশ্নও উঠেছে। হোয়াইট হাউজের সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ডেভিড অ্যাঙোরড বলেছেন, সব কিছুর জন্যই সেখানে একটি নিয়ম (প্রটোকল) আছে। যদি সন্ত্রাসী বা পরমাণু হামলা হয় তবে কী করতে হবে হোয়াইট হাউজে নিয়মিত তার অনুশীলন চলে। তবে সত্যি বলতে, বর্তমান মহামারীর মত পরিস্থিতি, যেটা হোয়াইট হাউজকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেটা কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না।
ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রধান ইয়ান ব্রেমার বলেন, যদি ট্রাম্প অসুস্থতার কারণে সরকার পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী তিনি অস্থায়ীভাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারবেন এবং কাজে ফেরার মত সুস্থ হয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতেও পারবেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দুইবার এভাবে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন। এছাড়া, অস্ত্রোপচারের কারণে আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানও একবার ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন। এমনকি যদি প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট দুজনেও যদি কোনো কারণে মারা যান বা একসঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে কী করতে হবে তাও সংবিধানে বলা আছে। জর্জ মাসন ইউনিভারর্সিটির আইনের অধ্যাপক ইলিয়া সমিন বলেন, এরকম হলে হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। পরিস্থিতি যদি তেমনই হয় এবং বিরোধীদল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ন্যান্সি পেলোসিকে যদি ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয় তবে আইনে যতই সেই ব্যবস্থার কথা উল্লেখ থাকুক, ‘বিশৃঙ্খলা নিশ্চিত’ বলে সতর্ক করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে একটি সাংবিধানিক সংকটের আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা জন সোপেল বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, এটি একই সঙ্গে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা, কিন্তু আবার অবাক হওয়ার মতো কোন ব্যাপারও নয়।এটি একারণেই অত্যাশ্চর্য কারণ, প্রেসিডেন্টকে ঘিরে নেয়া সব ব্যবস্থার পরও যে তিনি আক্রান্ত হলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে ঘিরে নিরাপত্তার তুলনীয় আর কিছু নেই। যারা তাকে ঘিরে রাখেন, তাদের সারাক্ষণ করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে যেসব গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলো যদি তার না থাকে, তাহলে হয়তো ট্রাম্প আবারও করোনাভাইরাস যে সেরকম গুরুতর কোন ব্যাপার নয়, সেরকম একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা করবেন। তিনি আবারও বলার চেষ্টা করবেন, এটা নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। আবার যদি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেটা থেকেও তিনি রাজনৈতিক ফায়দা পেতে পারেন। তার জন্য সহানুভূতির ঢেউ উঠতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর। খবর বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।