শাহ আবদুল করিম – বাংলা গানের কিংবদন্তি কৃতী পুরুষ। একাধারে তিনি ছিলেন শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। লোক সংস্কৃতি আর আধুনিক সংস্কৃতির ঠিক প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ তিনি। ভাটি অঞ্চলের শিল্পী আবদুল করিম শহুরে মানুষের কাছেও ছিলেন জনপ্রিয়। গানের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে পেতে চেয়েছেন। জীবাত্মার মাধ্যমে পরমাত্মার সন্ধান লাভই ছিল তাঁর সাধনা।
শাহ আবদুল করিমের জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে। ছেলেবেলায় লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। বারো বছর বয়সে গ্রামের এক নৈশ বিদ্যালয়ে প্রথমিক শিক্ষা নেন। পরবর্তী সময়ে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন এই বাউল সাধক। তাঁর সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলাতেই। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি সমাজের সকল অন্যায়, অনাচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গানে গানে কথা বলেছেন তিনি। প্রচুর গণসংগীত রচনা করেছেন। চরম দারিদ্র্য আর জীবনের কঠিন বাস্তবতা – এক কথায় নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে এইসব গানে। গানগুলো ভীষণ জনপ্রিয়ও। কিন্তু গণসংগীত শিল্পীর পরিচয় ছাপিয়ে বাউল শিল্পী হিসেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সংগীত পরিবেশনের জন্য সরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। পীর-দরবেশের খুব ভক্ত ছিলেন আবদুল করিম। তাঁর চোখে স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত শ্রেণি সমাজ ব্যবস্থার। তাঁর গানে ঈশ্বরের কাছে অনুযোগ, ‘পৃথিবী তুমি বানালে, বানায়ে তুমি কাউরে ধনী বানাইছো, কাউরে গরিব বানাইছো, এটাই আমি মানতে পারি না।’ শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় কিছু গান: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, ‘কেমনে ভুলিব আমি বাঁচিনা তাঁরে ছাড়া’, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে’, ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’ ইত্যাদি। আবদুল করিমের গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ছয়টি গানের বই।
এগুলো হলো: ‘আফতাব সংগীত’, ‘গণসংগীত’, ‘কালনীর ঢেউ’, ‘ভাটির চিঠি’, ‘কালনীর কূলে’ এবং ‘দোলমেলা’। বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে তাঁর দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ। ২০০১ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ভাটির পুরুষ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন মাটির শিল্পী, গণমানুষের শিল্পী শাহ আবদুল করিম।