জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব (২০১৬) অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৬ ভাগ ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে শতকরা ১৮ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। দিন দিন এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। কিন্তু বাড়ছে না চিকিৎসকের সংখ্যা। চট্টগ্রামসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে মানসিক রোগীর চিকিৎসায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা দশজনের বেশি নয়।
এদিকে, করোনা মহামারিতে মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু চিকিৎসা সুবিধা বাড়েনি। চট্টগ্রামে বলতে গেলে এ রোগের চিকিৎসা সুবিধা আরো সংকুচিত হয়েছে। এরই মাঝে দেশব্যাপী আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। মানসিক রোগীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে সার্বিক উন্নয়ন সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও উদযাপিত হতে যাচ্ছে দিবসটি। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা দক্ষিণাঞ্চলে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত আছেন এমন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা দশজনের বেশি নয়। প্রায় ৫ কোটি জনসংখ্যার এ অঞ্চলের জন্য যা শুধু অপর্যাপ্তই নয়, অপ্রতুলও। অথচ, রোগের তালিকায় ‘মানসিক বিষণ্নতা’ বর্তমানে সামনের সারিতেই। ২০৩০ সালে এই রোগটি শীর্ষে চলে আসতে পারে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে ৬০ শয্যায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও করোনা পরিস্থিতিতে বিভাগটি অন্যত্র স্থানান্তর করে হাসপাতাল প্রশাসন। বর্তমানে নতুন (আউটডোর) ভবনের ৫ তলায় এ বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। যেখানে ৬০ শয্যার স্থলে বর্তমানে ২০টিরও কম শয্যায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
মানসিক রোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিভাগের আউটডোরে প্রায় ১১ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ইনডোরে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে তিনশ রোগী। চিকিৎসাসেবা নেওয়াদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগী সবচেয়ে বেশি। মোট রোগীর ৩৫ শতাংশ। এরপরই মেজাজ সংক্রান্ত ডিজঅর্ডার জটিলতায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন বেশি, যা মোট রোগীর ৩০ শতাংশ। জানা গেছে, বিভাগে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। সহকারী অধ্যাপক পদের ওই চিকিৎসক বর্তমানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে আছেন। ওয়ার্ডে একজন সহকারী রেজিস্ট্রার ও আউটডোরে আরো একজন চিকিৎসক রয়েছেন। তবে তারা দুজন অন্য বিভাগের। চিকিৎসক সংকটের কারণে এই বিভাগে তাদের পদায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৬০ জন রোগী ওয়ার্ডের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন জানিয়ে বিভাগের প্রধান ডা. পঞ্চানন আচার্য আজাদীকে বলেন, আন্তঃবিভাগে শয্যা সংখ্যা কম হওয়ায় অনেক রোগীকে ভর্তি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জনবল সংকটসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝে রোগীদের যথাসাধ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। দিন দিন যেহেতু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সেহেতু জনবল ও শয্যা সংখ্যাসহ বিভাগের সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়ানো জরুরি।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে মনোরোগ বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বড় জোর দশজন। চমেক হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডা. মহীউদ্দিন এ. সিকদার বলেছিলেন, এই অঞ্চলের বিশাল সংখ্যক মানসিক রোগীর চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। এটা শুধু এই অঞ্চলে নয়, গোটা দেশের চিত্রও একই রকম। সারা দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা একশজনের কিছু বেশি।
এদিকে, দিন দিন এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ছে না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি দেশের সব মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ নেই। দেশের মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানে বিষয়টি পড়ানো হয়। ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বিষয়টি পড়ার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। এসব প্রতিষ্ঠানে বিষয়টির আসন সংখ্যাও হাতে গোনা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বিষয়টি পড়ার সুযোগ নেই বলে জানান ডা. মহীউদ্দিন এ. সিকদার। তিনি বলেন, এই রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বৃদ্ধি না পাওয়ার পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন বিষয়টি কঠিন। পাস করা দুরূহ। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি পড়তে ভয় পায়। সমাজ এই রোগের চিকিৎসকদের ‘পাগলের ডাক্তার’ বলে হেয় করে। এছাড়া প্রায় সময় রোগীদের হামলার শিকার হয় এই রোগের চিকিৎসকরা। সব মিলে বিষয়টি পড়তে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম অনীহা। মূলত এসব কারণেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ছে না। এই সমস্যা থেকে উত্তরণে বিষয়টি আরো বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগসহ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনও জরুরি।