রুদ্র প্রকৃতিকে পাঠ করবে এমন খনা কই?

রিতু পারভী | শনিবার , ২০ এপ্রিল, ২০২৪ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

বার মাসে বার ফল না খাইলে রসাতল ’ খনার এই বচনে যখন সুর পড়লো, শুধুই খনাকে উপলক্ষ করে প্রথমবারের মত একটা মেলার আয়োজন হল দূর কেন্দুয়ার আঙারোয়া গ্রামের সরল আবহে, সব কেমন হৃদয়ে গেঁথে গেল। সারাদিন, সুরে বাঁধা খনার বচন গুনগুনিয়ে গাইছিলাম আর ভাবছিলাম প্রাজ্ঞ এই নারীর কথা। উপরের সত্য সহজ এই বচনে কত রোগ শোকের সমাধান রয়েছে। কত কত সমস্যাকে উড়িয়ে দিতে পারে এই সহজ নিয়ম পালনে। বার মাসে বার ফল, ঋতু বদলের সাথে সাথে নানান ফলমূল বারমাস জুড়ে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। যে সময়ে যে রোগ ঠিক সে সময়ে তার প্রতিষেধক ফল প্রকৃতিতে থাকে। শরীর নামক যন্ত্রটা কতখানি প্রকৃতির সাথে জড়িয়ে আছে তা হাজার বছর আগে একজন নারী তাঁর সহজ বচনে বলে গেছেন আর আমরা এই সময়ে এসে রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাচ্ছি এর বাস্তবতা।

খনা বা ক্ষণা এক বিদূষী নারীর নাম যার আরেক নাম লীলাবতী। ধারণা করা হয় সিংহল রাজকন্যা তিনি, রাজার ঘরে জন্ম। যিনি বিয়ের পর স্বামীর সাথে চলে আসেন বাংলায়। সিংহল রাজসভার জ্যোতির্বিদ বরাহ পুত্র মিহির ছিল তার স্বামী। ক্ষণজন্মা খনা ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী এক নারী যিনি প্রকৃতিকে সূক্ষ্মভাবে পাঠ করেছিলেন, তাই জানতেন কখন কী ঘটতে যাচ্ছে প্রকৃতিতে, কী করলে ভালো, কীসে মন্দ।

শুধু প্রকৃতি নয় মানুষের নিত্য জীবনের খুঁটিনাটি শত কিছু নিয়ে রয়েছে তাঁর সহজ, সত্য বচন। যেমন

সকাল শোয় সকাল ওঠে

তার কড়ি না বৈদ্য লুটে।’

আলো হাওয়া বেঁধো না

রোগে ভোগে মরো না।’

একে তো নাচুনি বুড়ি

তার ওপরে ঢোলের বাড়ি।’

দুই লাইনের ছন্দে বাঁধা বচন আজও বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে এর প্রাসঙ্গিকতার কারণে। সময়ের সীমানা ভেঙে আজও খনার বচনের বাস্তবতা বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে।

কলকাতার কাছাকাছি বারাসাত নগরীর বীরচম্পা এলাকায় প্রাচীন যুগের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এই এলাকাটিই ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর সাম্রাজ্য। পুরাতত্ত্ববিদগণ মৌর্য্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের অনেক নিদর্শন উদ্ধার করেছেন এই এলাকা থেকে। আর এই এলাকায় মহাসড়কের পাশে রয়েছে বহু ভুজাকৃতি খনামিহিরের মূড়া। সিংহল রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির, তার পুত্র মিহির এবং পুত্রবধু খনা বা লীলাবতী, সকলেই জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী। খনার কৃষিভিত্তিক যে বচন সেগুলো ছিল কৃষকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলা ভাষায় রচিত এইসব বচন ছিল কৃষকদের মুখে মুখে। কৃষকরা খনার বচনে, গণনায় ভীষণভাবে উপকৃত হতে থাকলে রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁকে রাজসভার নবরত্নের দশম সদস্য ঘোষণা করেন।

বিদুষী এই নারীর বচন এখনো মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। বিশেষ করে কৃষকেরা এখনও খনার বচনে ভরসা করে কৃষিকাজ করে। মুক্তপ্রাণ প্রাজ্ঞ এই নারীর জ্ঞান, তাঁর স্বাধীনচেতা মন এবং বিশেষত তাঁর লিঙ্গ মানে নারীজন্ম তাঁকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। তাঁর জনপ্রিয়তা, তাঁকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়ে তাঁর শশুড় পুত্রকে দিয়ে তাঁর জিহ্বা কেটে নেন। কাটা জিহ্বার খনা এখনো প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। খনার মৃত্যু হয় দ্রুতই কিন্তু ক্ষণজন্মা খনা বেঁচে থাকেন হাজার বছর পেরিয়ে।

মানুষের উপর্যুপরি অত্যাচারে প্রকৃতি এখন বিরূপ, রুদ্র প্রকৃতিকে পাঠ করবে এমন খনা কই?

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজেই নিজেকে সম্মান দিতে হয়
পরবর্তী নিবন্ধএকটু ভাবুন