ইউক্রেন বলছে সেদেশে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের ঠিক দুই মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানীয় দুজন কর্মকর্তা রাজধানী কিয়েভে যাচ্ছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন রোববার কিয়েভ সফর করবেন। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এই সফর-পরিকল্পনার ব্যাপারে এখনও কোন মন্তব্য করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্দেশে ২৪ শে ফেব্রুয়ারি এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের এতো উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার এটাই প্রথম ইউক্রেন সফর। এর আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ মার্কিন নেতারা প্রতিবেশী পোল্যান্ড সফর করেছেন। গত আট সপ্তাহের এই যুদ্ধে ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। দেশের ভেতরেও উদ্বাস্তু হয়েছে আরো কয়েক লাখ মানুষ। খবর বিবিসি।
পশ্চিমা সহায়তা : যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই কর্মকর্তার সফরের সময় ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমর বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, সামরিক সাহায্য দেওয়া কিছুটা সহজ। কিন্তু অর্থনৈতিক সাহায্য বা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি সমাজকে পুনর্গঠন করা কঠিন- যা আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিম্বা সিরিয়া কোথাও করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি মনে করেন ইউক্রেনের এই যুদ্ধে পশ্চিমা নেতারা সামরিক সাহায্য যুগিয়ে যাবেন, কূটনৈতিক সহযোগিতাও দেখাবেন কিন্তু অর্থনৈতিক সাহায্য তারা কতোটা দিতে রাজি হবেন সে বিষয়ে বলা সম্ভব নয়। এর মধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন এই যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জয়লাভ করবেন। এই যুদ্ধে ইউক্রেন জয়লাভ করতে যাচ্ছে, রাশিয়ার কৌশলগত পরাজয় হতে যাচ্ছে।
কে জয়লাভ করছে? : প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শুরু থেকেই দাবি করছেন যে তারা এই যুদ্ধে জিতবেন, রাশিয়া কোনোভাবেই জিততে পারবে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও একাধিকবার বলেছেন যে পুতিন এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবেন না।
পশ্চিমা নেতারা কেন এধরনের দাবি করছেন? : সমরবিদ সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, যুদ্ধে জয়লাভ করার ব্যাপারে তারা কী বোঝাতে চাইছেন সেটা খুব স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, আমার ধারণা এ বিষয়ে ইউক্রেনের এক ধরনের মাপকাঠি রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ধরনের মাপকাঠি রয়েছে, যদিও এই দুটো দেশের চিন্তাধারার মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় রয়েছে, কিন্তু তার পরেও দুপক্ষের দুধরনের চিন্তাধারা রয়েছে। আর রাশিয়ার চিন্তাভাবনা একেবারেই ভিন্ন।
যুদ্ধ কতদিন চলবে : সমরবিদ সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, বিভিন্ন খবরাখবর দেখে মনে হচ্ছে ৯ই মে প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দিনটিতে রাশিয়ার বিজয় হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। শোনা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো সেদিন একটা ভাষণ দিয়ে রাশিয়ার সীমিত লক্ষ্য অর্জনের কথা বলে দেশবাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করবেন যে এই যুদ্ধের আর প্রয়োজন নেই।
তিনি মনে করেন মারিউপোল যদি সত্যিকার অর্থে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে তাকে রাশিয়ার আঞ্চলিক বিজয় বলে মনে করা হতে পারে। তবে পাশ্চাত্যের সহযোগিতা নিয়ে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার আরো ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে তাহলে তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন কি না তা বলা কঠিন।
দনবাস দখল করে পুতিনের কী লাভ? : বিডিনিউজের খবর থেকে জানা যায়, রাজধানী কিয়েভের কাছে খণ্ড যুদ্ধগুলোতে ধারাবাহিক পরাজয়ের পর সেখান থেকে সেনাদের সরিয়ে ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছে রাশিয়া, সেখানে তীব্র হয়ে উঠেছে লড়াই। দনবাসের দক্ষিণাংশে ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোলকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে রুশ বাহিনী এরইমধ্যে সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, কিন্তু ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী সেখানে আত্মসমর্পণ করেনি।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই রাশিয়া বলে আসছিল, কিয়েভ দখল করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। রুশ বাহিনীর জেনারেল রুস্তম মিনেকায়েভ শুক্রবার বলেছেন, ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের পুরো নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে চান, কারণ তাতে মলদোভায় রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের সাথে মস্কোর যোগাযোগের পথ পরিষ্কার হবে।
ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাংশের ওই পুরোনো শিল্পকেন্দ্র দখল করে আসলে কী স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন? আদৌ সেটা সম্ভব? এক প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি। দনেৎস্ক আর লুহানস্ক- এ দুই প্রদেশ মিলে দনবাস। এর একটি অংশে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আট বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর। তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত সেনারা সেখানেই নিয়োজিত। যুদ্ধের গত দুই মাসে তাদের বড় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা, তবু রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য তারা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।
পশ্চিমা অস্ত্রে আত্মবিশ্বাসী জেলেনস্কি দেখছেন ‘জয়’ : পশ্চিমা দেশগুলোর পাঠানো বিপুল সংখ্যক ভারী অস্ত্রশস্ত্রে উদ্দীপ্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, তার বাহিনী রাশিয়ানদেরকে পরাস্ত করতে প্রস্তুত।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ ও নৃশংস যুদ্ধ হতে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে; তার মধ্যে জেলেনস্কি শনিবার জয়ের ব্যাপারে এই আশবাদ ব্যক্ত করলেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
শনিবার রাতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, দখলদাররা ইউক্রেন ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে এমন দিন যে এগিয়ে আসছে, তা তাদের দেখাতে সক্ষম হবো আমরা।