রাউজান এক অগ্রসর জনপদের নাম

ড. নারায়ন বৈদ্য | শনিবার , ২৭ মে, ২০২৩ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

সাগর আর পাহাড় ঘেরা, কর্ণফুলি নদীর অববাহিকায় অতি প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছে এক জনপদ। এ জনপদে হাজারো মনীষীর জন্ম হয়েছে। জন্ম হয়েছে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক মাস্টারদা সূর্যসেন নামক এক বীরের। জন্ম হয়েছে নবীন সেন নামক এক বিখ্যাত কবির। শিক্ষাদীক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা এ জনপদের নাম রাউজান। এ জনপদ যে সব সময় সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা এক শান্তির জনপদ ছিল তা কিন্তু নয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এক সময় এ জনপদ হয়ে উঠেছিল অশান্ত। সমাজের ক্রম পরিবর্তন হয়। এ ক্রম পরিবর্তনের সাথে যদি অশান্ত রাজনৈতিক হাওয়া লাগে তবে তা হয়ে উঠে সন্ত্রাসের জনপদ। আর এ সময়কালে কখনো ছোট ছোট শান্তির নীড়গুলো ছায়া সুশীতল হয়ে উঠে না। বরং হয়ে উঠে অশান্তির এক জনপদ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের এই রাউজান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের যে বিশাল অবদান রেখেছিল তা এই রাউজান। এ অঞ্চলের আলোবাতাসে বড় হয়ে উঠা কত লোক। শিক্ষা দীক্ষায় এমন কি প্রশাসনেও অবদান রেখেছে এবং অবদান রেখে চলেছে তার কোনো হিসাব নেই। চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতিতেও এ জনপদের মানুষের অবদান অনেক বেশি। শুধু তাই নয়। সংবাদপত্রের প্রকাশনা যা এ অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত সজাগ রাখে তাতেও অবদান এ অঞ্চলের।

সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ের অশান্ত জনপদ আজ হয়ে গেছে শান্ত। বিগত শতাব্দীর আশি ও নব্বই এর দশকে রাউজান নামক যে জনপদটি ছিল সন্ত্রাস এর অভয়ারণ্য, আজ সেই জনপদ হয়ে উঠেছে ছায়াঘেরা সুশীতল জনপদ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এমন সৌভাগ্যবান উপজেলা খুবই কম। কিন্তু রাউজান উপজেলা এদিক থেকে খুবই সৌভাগ্যবান উপজেলা। রাউজানে রয়েছে ‘চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)’। অবশ্য হাটহাজারী উপজেলাতেও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’। একটি উপজেলাকে তখনই উন্নত উপজেলা বলা হয়, যদি উক্ত উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সুবিধা বজায় থাকে। এদিক থেকে রাউজান উপজেলা এগিয়ে। রাউজান উপজেলার পাশে রয়েছে রাঙ্গুনিয়া এবং পার্বত্য জেলা। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার লোকদেরকে রাঙ্গামাটি রোড হয়ে শহরে আসতে হয়। আবার এ রাঙ্গামাটি রোড অতিক্রম করেছে রাউজান উপজেলার ওপর দিয়ে। এ কারণে রাঙ্গুনিয়া, পার্বত্য জেলা ও রাউজানের লোকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রাঙামাটি রোডটিকে করা হয়েছে চার লেইনের যা ঢাকাচট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডের ন্যায়। এ রোডের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। রাউজান উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ অংশের লোকদের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধার্থে উপজেলার প্রতিটি রাস্তাকে প্রশস্ত করা হয়েছে।

শহরাঞ্চল ছাড়া উপজেলাতে সাধারণতঃ কোনো সরকারি আবাসিক এলাকা গড়ে উঠে না। রাউজান হচ্ছে এমন এক উপজেলা যেখানে পিংক সিটি১ ও পিংক সিটি২ নামে দুইটি আবাসিক এলাকা সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে আবাসিক প্লটগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখন প্লটগুলো রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে হস্তান্তরের কাজ চলছে। শুধু তাই নয়। বিগত দশকে রাউজান উপজেলার অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। রাউজান মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, উপজেলা স্মৃতি সৌধ, রাউজান পৌরসভা ভবন, বেনবেইস ভবন, শেখ কামাল কমপ্লেক্স, প্রায় দুই হাজার পাকা সড়ক, হালদা ব্রিজসহ উপজেলার ৮টি বড় ব্রিজ ও শতাধিক কালভার্ট, বঙ্গবন্ধু আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হালদা নদী প্রকল্প, চুয়েট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্প্রসারণ, ১২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ইত্যাদি।

শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাউজানের বিভিন্ন স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলোতে অনার্স চালুকরণ, চুয়েটে আইটি পার্ক নির্মাণ, রাউজান কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ স্থাপন, রাউজান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন, রাউজান কলেজ ও রাউজান আর.আর..সি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করা হয়েছে। প্রায় ৩০টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় রাউজানে স্থাপন করা হয়েছে। রাউজানে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করার লক্ষ্যে গহিরা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র স্থাপন, রাউজান পিংক সিটির এম.ভি.এ বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র স্থাপন, রাউজান (পূর্ব গুজরা) গ্রিড উপকেন্দ্র স্থাপন, শত শত সোলার সড়ক বাতি স্থাপন করা হয়েছে এ রাউজানে।

রাউজানের বিখ্যাত কবিসাহিত্যিক ও বিপ্লবীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য করা হয়েছে নবীন সেন কমপ্লেক্স, মাস্টারদা সূর্যসেন কমপ্লেক্স, মাস্টারদা সূর্যসেন স্মৃতি ভবন ও পাঠাগার এবং একটি সূর্যসেন চত্বর। ৩১ শয্যা বিশিষ্ট সুলতানপুর ভবন সম্প্রসারণ, ৫০টিরও অধিক রাউজানের বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। কদলপুরে ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিক, হাসপাতাল রাউজানের মানুষদের স্বাস্থ্য সেবায় অবদান রাখছে অধিক। রাউজানের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রাউজান থানায় নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক ভবন। আরো নির্মাণ করা হয়েছে নতুন হাইওয়ে থানা ভবন। নির্মাণ করা হয়েছে চিকদাইর পুলিশ ফাঁড়ি। শিশুকিশোরদের খেলাধুলার মনোনিবেশ করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে উপজেলা সরকারি স্টেডিয়াম, সংস্কার করা হয়েছে বিভিন্ন মাঠ। ২০১৭ সালে ১ ঘণ্টায় ৪ লাখ ৮৭ হাজার ফলদ চারা রোপণ করে সারা বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এ রাউজান উপজেলা। এ উপজেলায় স্থাপন করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, উপজেলা সার্ভার সেন্টার, ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবন, উপজেলা পরিষদের নতুন ভবন, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু বিকাশ কেন্দ্র ইত্যাদি। আরো রয়েছে অটিজম কেন্দ্র, শিশু সংশোধনাগার, উপজেলা মডেল মসজিদ প্রকল্প, রাউজান ঢালারমুখ এলাকায় শিল্পনগরী, ট্রমা সেন্টার। একই সাথে বাস্তবায়নধীন রয়েছে বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ। সর্বশেষে রাউজান উপজেলার জন্য চমক রয়েছে রেল লাইন। চট্টগ্রাম শহরের পূর্বাঞ্চলের মানুষ কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, এ অঞ্চলে রেললাইন থাকবে। সেই আশা পূর্ণ করার লক্ষ্যে বর্তমান প্রশাসন চট্টগ্রাম থেকে রেললাইন প্রথমে চুয়েট পর্যন্ত সম্প্রসারণ করবে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে তা কাপ্তাই পর্যন্ত প্রসারিত হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান প্রশাসন জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

আমি রাউজান উপজেলার অধিবাসী হলেও ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করার পর উচ্চতর পড়াশুনার জন্য যে শহরে এসেছি তা থেকে আর গ্রামে ফিরে যাওয়া হয়ে উঠেনি। এমন কি বিগত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে রাউজানের রাস্তাঘাট ও সামগ্রিক অবকাঠামো এতই অনুন্নত ছিল যে, দক্ষিণ রাউজানের মানুষেরা কখনো উত্তর রাউজানে যেত না। কালেভদ্রে যদি যেতেও হতো তবে তা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ছোটকালে রাউজানের মধ্যখানে বিনাজুরী এলাকায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। বর্ষার কাদা মাড়িয়ে সেদিন কিভাবে যে গিয়েছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাসে। এ কারণে আমার এ পড়ন্ত বেলায় এসেও কখনো রাউজান থানায় যাওয়া হয়ে উঠেনি। গত ৮ মার্চ (২০২৩) তারিখে একান্তই নিজের প্রয়োজনে উত্তর রাউজান (মদের মাহল) এলাকায় যায়। উদ্দেশ্য রাউজানের উন্নয়ন দেখা ও নিজের একটি কাজ সারা। আমাদের গাড়ি যখন হাটহাজারী থেকে রাঙামাটি রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তখন অবাক হলাম যে চার লেইন এর রাস্তা দেখে। যদিও রাস্তার কিছু কিছু অংশের কাজ এখনো বাকী আছে তবুও এত বড় একটি আঞ্চলিক রোড দেখে অবাক হলাম। যথাসময়ে মদের মাহল এলাকায় পৌঁছে গেলাম। আমার ব্যক্তিগত কাজটি সেরে উন্নয়ন সম্পর্কে অবগত হবার জন্য বেশ কিছু মানুষের সাথে আলাপ করলাম। সব মানুষ তাদের নিজ এলাকা উন্নয়নে খুবই খুশি। তখন বেলা মাত্র ১টা। শখ হলো আমি একটু থানা দেখবো। মানুষের সাহায্য নিয়ে পায়ে হেঁটে থানায় উপস্থিত। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কক্ষে প্রবেশ করে নিজের পরিচয় দিতে ওসি মহোদয় স্বাগত জানালেন। সাথে সাথে তিনি এক কাপ চাএর আদেশ দেন। ওসি সাহেবের বাড়ি কুতুবদিয়া। কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে চা খাওয়া শেষ হলো। রুমে প্রবেশ করলো বেশ কয়েকজন জনতা। ভাবলাম, ওসি সাহেবের পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ। কাজেই সময় নষ্ট না করে ওসি সাহেব থেকে বিদায় নিলাম। বাইরে এসে সামনে পুকুরপাড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমার গন্তব্যস্থলে চলে এলাম। গাড়িতে উঠে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলামএসব ধারাবাহিক উন্নয়নের কাণ্ডারী কে? বিগত দিনে রাউজানের জনগণ কত নেতাকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছে। এমন উন্নয়নতো তখন হয়নি। আর বর্তমান রাউজানের সেই উন্নয়নের কাণ্ডারী হয়রাউজানের বর্তমান সাংসদ, রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জনাব এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।

লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি

পূর্ববর্তী নিবন্ধরম্যসাহিত্যিক অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধকমিউনিটি ক্লিনিকের বিশ্বস্বীকৃতি