দুই দশক ধরে প্রবাসে সোমা। বুকের ভেতর নিরন্তর বাস করে ওর- বাংলাদেশ। সরকারি কর্মকর্তা বাবা-মা কর্মজীবনের বেশীরভাগ সময় চট্টগ্রামে কাটিয়েছিলেন। সেই সুবাদে সোমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামেই। অবসরে যাবার পর বাবা মা থিতু হয়েছিলেন রাজধানীতে। দুজনেই চলে গেছেন না- ফেরার দেশে। সে অনেকদিন আগের কথা। কিন্তু জন্মভূমির মায়া ছাড়তে পারেনি সোমা। প্রতি বছরই দেশে আসা চাই। আর দেশে এলে চট্টগ্রামে আসা চাই চাই-ই।
চট্টগ্রামে এলে সোমা ফিরে পেতে চায় দুরন্ত শৈশব, উচ্ছ্বল কৈশোর। খুঁজে ফেরে সে খাস্তগির স্কুল আর চট্টগ্রাম কলেজের দিনগুলি। খুঁজে বের করে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের।
মন ছুটে যায় তার নগরীর ঝলমলে প্রেক্ষাগৃহেও। বাবা মা’র সাথে প্রায়ই যেতো সে, নতুন কোন চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে। কোন ছবি ভালো লাগলে কয়েকবারও যেতো ওরা। মামা খালা, চাচা, নানু এলেও দলবেঁধে ওরা সিনেমা দেখতে যেতো। বিরতির সময় বাদাম ভাজা কিনতে বের হতো মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে। পরে পরে চিপস আর কোক ফানটা এসে গেলো বাদামের জায়গায়। নানুকে ধরে ধরে শৌচাগারে নিয়ে যেতো সোমা। সবকিছু ছিল হাতের কাছে। ঝকঝকে তকতকে। ছবি দেখার সুখস্মৃতিতে বুঁদ হয়ে থাকতো কিছুদিন। বন্ধুদের কাছে গল্প করতো। বন্ধুদের অনেকেও যেতো সিনেমায়। গেল শতকের আশির দশকের কথা।
বইয়ের পোকা সোমা আসলে সিনেমারও পোকা। তবে বইটা হতে হবে বাংলায়। সিনেমাটাও। তাই প্রবাসে বাংলা ছবি এলেই তা দেখে ফেলার জন্য ছটফট করে। ব্যস্ত রোজনামচা থেকে ঠিক ঠিক সময় বের করে নেয়। কিন্তু মন ভরে না। মনের পাতায় ভেসে ওঠে চট্টগ্রামের সেই প্রেক্ষাগৃহের কথা। অনেক অনেক দিন যাওয়া হয়নি ‘আলমাসে’।
বছর দুই আগে চট্টগ্রামে বেড়াতে এলে একান্ত তিনটি ঘণ্টা বের করে নেয় সোমা; আলমাসে যাবে বলে। আজ সে যাবেই যাবে। নাইবা থাকুক হালদা, কিংবা গহিন বালুচর। যা আসে পর্দায়, তাই দেখবো- স্বগতোক্তি সোমার। সঙ্গী এক আনকোরা বন্ধু, যে রূপোলী পর্দা প্রথম দেখেছিল চল্লিশে পা দেবার পর। নয় বছরের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শিশুতোষ দিয়েই অভিষেক। এরপর সবমিলিয়ে হাতে গোনা দুই কি তিনবার সে গিয়েছিল প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে। তবে চট্টগ্রামে নয়।
দেশি দশে যাবার জন্য সিএনজি ভাড়া করে একটু পর সোমা চালককে আলমাসে যাবার নির্দেশনা দিলে ভড়কে যায় বন্ধুটি। ছেলে মেয়ে আর বাবাদের বাড়ি রেখে এসেছে। না জানি কতো সময় চলে যায় পথে-পথে। জ্যামের তো কোন ঠিক ঠিকানা নাই এই শহরে। হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে ওদের মাথায়। তবুও ওরা মনস্থির করে ফেলে। আজ ওরা দুরন্ত। অনেক অনেক দিনের পর আজ ওরা দুজনে দুজনার।
অনেক জ্যামজট পেরিয়ে আলমাসের বিশাল তোরণের কাছে থামে ওরা। ‘ঢাকা এ্যাটাক’ এর টুকরো টুকরো ছবি নিয়ে তৈরি বড় বিজ্ঞাপনচিত্র ঝুলছে মাথার ওপর। কাগজে বেশ নাম হচ্ছে এই ছবিটা নিয়ে। যাক, অনেক সাধের বিকালটা মাঠে মারা যাবে না মনে হচ্ছে। ঝটপট ভেতরে ঢুকে পড়ে সোমা। ওকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে বন্ধুটি। সব কেমন শান্ত নিরিবিলি। কোলাহল নেই কোথাও। এমন চুপচাপ সিনেমা হল আগে কোনদিন দেখেনি সোমা। তবে কি বিকেলের শো শুরু হয়ে গেছে! খুব কী দেরি হয়ে গেল!
ঈ্রধান ফটক পেরিয়ে আঙিনা। মাঝখানে গোল একটা স্থাপনা। দেখেই বোঝা যায় কোনদিন ফুলের বাগান ছিল এখানটায়। খোলা বারান্দার মেঝেতে বরফির ছাঁচের মতো মোজাইক। অনেক দিন ধোয়ামোছা হয়নি। হারিয়ে গেছে আগের সেই উজ্জ্বলতা। আভিজাত্য আর ঐতিহ্যের গন্ধটা তবু রয়ে গেছে। বরাদ্দ অর্থের সবটুকুই নিশ্চয় ঢালা হয়েছিল এই প্রেক্ষাগৃহের প্রথম নির্মাণে। সেই সাথে মমতাও।
দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। রঙ করা হয়নি অনেকদিন। আলোর ঝলকানি নেই নায়ক-নায়িকার ছবির ওপর। পুরো প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে ছায়াছবির কিংবা নায়ক-নায়িকার স্থিরচিত্রও সাঁটা নেই আগের মতো। শ্রীহীন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে সবকিছু। খুপড়ির মতো জানালার ছোট্ট ফুটো দিয়ে টিকেট বিক্রি হচ্ছে। এতো সস্তা টিকেট! চমকে ওঠে সোমা। টিকেট হাতে এগিয়ে যায় ওরা। দুজন দর্শককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান জনা তিনেক কর্মী। এঁদের বুঝি কোন কাজকর্ম নেই। অনুজ্জ্বল আলোয় সরু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যেতে থাকে সোমা আর তার বন্ধুটি। চড়া শব্দে হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে ভেতর থেকে। গা ছমছম করে উঠে বন্ধুটির; এ কোথায় এলাম !
তিন কর্মী টর্চ জ্বালিয়ে নিয়ে যান ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্যাঁতস্যাঁতে। গুমোট। সেই সাথে পেটগুলানো দুর্গন্ধ। এই সেই প্রেক্ষাগৃহ! সামনে বিশাল পর্দা; এখনও ঘুমন্ত। শ’খানেকআরাম কেদারা শূন্য পড়ে আছে। একদম ওপরে পেছনের সারিতে সব মিলিয়ে জনা দশেক দর্শক। একটাই পরিবার। বাকি ক’জন জোড়েজোড়ে বসা। সোমাদের জোড়াটাই বেমানান এখানে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। মুঠোফোনের বাতি জ্বালিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে কেউ কেউ। মাঝ বরাবর পাশাপাশি দুই আসন নিয়ে বসে পড়ে সোমারা। নড়েচড়ে আরাম করে বসতে গেলে পায়ের সাথে লেগে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সামনের চেয়ারটি। ভাগ্যিস কেউ বসে নেই ওপাশটায়।
মিনিট দশেক পর এক্কেবারে ঠিক সময়ে আলো ফুটে বিশাল সেই রূপোলী পর্দায়। শুরুতেই জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীতের সুর। দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা। বুকের ভেতর কোথায় গিয়ে বিঁধে সুরটা! চোখ ভিজে ওঠে ওদের। সুর থেমে যেতেই ‘ঢাকা এ্যাটাক’। টানটান উত্তেজনা। নাটকীয়তায় ভরপুর। দৃশ্যায়নে রুচিবোধ আর কারিগরি দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট (যদিও গল্পটা ধার করা বলেই মনে হল)। ছবি শব্দ সব ঝকঝকে পরিষ্কার। কিন্তু ছায়াছবির সঙ্গে একাত্ম হতে পাওে না ওরা। এ কোথায় এলাম? ভাবছে সোমা; ঠিক যেন ভূতের বাড়ি।
নিরাপত্তার অভাব আরও স্পষ্ট। অসামাজিক অনৈতিক কাজের জন্য তীর্থস্থান হতে পারে এই প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তর। নানান চিহ্ন দেখতে পায় ওরা আনাচে-কানাচে। বিরতির সময় খাবারের খোঁজে বের হয় দুজনে মিলে। খাবার তো নয়, সোমা আসলে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। কোনকিছু নেই আর আগের মতন। খাবারের দোকানেও জীর্ণদশা। চোখেমুখে একটু পানির ঝাপটা দেবার জন্য প্রক্ষালন কক্ষের খোঁজ করে ওরা। পথ দেখিয়ে দেবার জন্য এখানেও এগিয়ে আসেন জনা কয়েক কর্মী। ভাঙ্গা নোংরা দুর্গন্ধে ভরা সেই কুঠুরি থেকে অক্ষত এবং বমি না করে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সোমারা।
বিজ্ঞাপন বিরতি তখনও চলছিল। টেলিভিশনের মতো এখানেও ভারতীয়, আর পাকিস্তানী বিজ্ঞাপনের জয়জয়কার। বাংলাদেশে বেশ ভালো ভালো বিজ্ঞাপন নির্মাতার আবির্ভাব হয়েছে, পুরস্কার পাচ্ছেন অনেকে- সোমা বিদেশে বসেও শুনতে পেয়েছে। কিন্তু পর্দায় উর্দু হিন্দি ঠোঁটে বিদঘুটে বাংলা বসিয়ে দিব্যি লভ্যাংশটুকু গুনে নিচ্ছে ভারতীয়, পাকিস্তানী বিজ্ঞাপন সংস্থারা। হিসেব মেলাতে পাওে না সোমা। ওর মনে পড়ে যায় গেল শতাব্দীর আশি-নব্বই এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলোর কথা। চা পাতা, চিপস, কোমল পানীয়, গুঁড়োদুধ, বেবি লোশনছাড়া নানান নামের ছাপা শাড়ির বিজ্ঞাপনগুলো অনেক রুচিশীল ছিল। আকাশ সংস্কৃতির চাপে সবই বুঝি সেকেলে হয়ে গেল!
নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় পূর্ণদৈর্ঘ্য সেই ছায়াছবির বাকি অংশ। সোমা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তার প্রিয় প্রেক্ষাগৃহের এই দৈন্যদশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একসময়ের কৃতি শিক্ষার্থী সে। এখন বিদেশে বড় ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠা এবং নিঃশব্দে কাজ করার স্বীকৃতি ‘নিরব কর্মী’র পদক ওর ঘরে। টাকার অভাবে এই দৈন্য! কিছুতেই নয়।
চলচ্চিত্র এখনও জনপ্রিয়, এখনও লাভজনক। বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরে আসছে, কাগজে প্রায় দেখা যায়। সুধী সমাজেও এনিয়ে আলাপ হয়। দৈন্য আসলে আমাদের স্বভাবে, দৈন্য আমাদের রুচিতে। গণমানুষের কিংবা সরকারি সম্পদের কোন যত্ন নেওয়ার দরকার মনে করি না আমরা নাগরিকরা। তাইতো ঝকঝকে সড়কের ওপর গড়ে ওঠে আবর্জনার পাহাড়। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থাপনা কিংবা ইমারত ধুলোবালি ঝুলকালিতে হারিয়ে ফেলে ঔজ্জ্বল্য। ঐতিহ্য সংরক্ষণের ধার ধারি না আমরা। পরিচর্যার অভাবে একসময় তা হয়ে যায় ধ্বংসস্তূপ। উন্নয়ন আর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কতো তহবিল আসে সরকারি বেসরকারি খাতে! একটু চুনকামের ধোঁয়া লাগিয়ে দিয়ে সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
সোমা স্বপ্ন দেখে আবারও ঝলমল করছে রঙমহল। কানায়-কানায় পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। আসনগুলো সব শক্ত মজবুত। নিরাপদ বোধ করছে প্রতিটি দর্শক। শৌচাগারের ভারী দুর্গন্ধে গুলিয়ে উঠছে না রঙমহলের ভেতর বাহির। বিরতির সময় মজা করে বাদাম, ফুচকা, চিপস কিংবা গরম-ঠাণ্ডা পানীয় নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠছে সবাই প্রিয়জনের সাথে।