‘যে আছে মাটির কাছাকাছি’

জীবন ঘনিষ্ঠ কবিয়াল ফণী বড়ুয়ার স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

রীতা দত্ত | সোমবার , ২৪ জুন, ২০২৪ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

কৃষাণের জীবনে শরিক যে জন কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন।’ কবিয়াল ফণী বড়ুয়া কর্মে ও কথাই সত্য আত্মীয়তা অর্জন করেছেন, জীবনের সাথে জীবনের যোগ ঘটিয়েছেন, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ গানের পসরা সাজান নি।

কবি গান আমাদের লোকঐতিহ্য ও সাহিত্যের বহমান ধারা। লোকগীতি লোকজীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের দেশ কেবল ধানের দেশ, বানের দেশ নয়, গানেরও দেশ। চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় বিষয় হচ্ছে কবিগান। বলা হচ্ছে লোক সংস্কৃতির প্রাণ চট্টগ্রামের কবিগান। যুগ যুগ ধরে নানা গায়েন, কথক, সাধক, পীর, ফকির, সাধুসন্তজনের ঐতিহ্যে ও অবদানে আমাদের লোকসাহিত্য ভরপুর এবং সমৃদ্ধ।

কবিয়ালগণ গদ্যে কিছু বলেননি। বলেন পদ্যে, ছড়ায় এবং তাতে থাকে অপূর্ব হৃদয় ছোঁয়ানো সুর ও ছন্দ। কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই যে কোন বিষয়ের ওপর তাৎক্ষণিক উপস্থাপনা বিস্ময়কর। এতে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে দুজন কবিয়াল দুই বিপরীত অবস্থানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন বাকপটু এ কবিয়ালগণ। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে পরস্পরের যুক্তি খন্ডন করে থাকেন। বিতর্ক যুদ্ধে তাঁরা নামেন বলে একে কবির লড়াই বলা হয়ে থাকে। কবিগান একধরনের বিতর্ক প্রতিযোগিতা অবশ্যই শুষ্ক কথায় নয়, রসালো সুরে ও ছন্দে।

ফণী বড়ুয়া মূলত একজন কবি এবং কবিয়াল। তিনি গান লিখেছেন এবং তাঁর দরাজ সুরেলা কন্ঠের উপস্থাপনায় তিনি গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন পাঁচখাইন গ্রামে ১৯১৫, ৩ জুলাই তাঁর জন্ম। বাবা নন্দ কুমার বড়ুয়া, মা শ্যামা বড়ুয়া। শৈশব থেকে দারিদ্রের সাথে কঠোর সংগ্রাম করেছেন তিনি। এক সময় জীবিকার জন্য বার্মা যান। অবসর সময়ে গান গেয়ে সাথীদের মনোরঞ্জন করতেন। শৈশব থেকেই গানের প্রতি ছিল অসাধারণ আকর্ষণ। ১৯৩২ সালে দেশে ফিরে আসেন। এ সময় কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল এবং অপরাজেয় কবিয়াল করিম বখশ এর কবির লড়াই দেখে ও শুনে তাঁর কবিয়াল হওয়ার বাসনা জাগে এবং রমেশ শীলকে গুরু হিসাবে বরণ করে নেন। উপযুক্ত গুরুর উপযুক্ত শিষ্য। রমেশ শীল তাকে বলেছিলেন, কাগজে কলমে কবি গান শিখা যায় না, পর্যবেক্ষণ ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শিখতে হবে।” রমেশ শীল তাঁকে নিয়ে যাবেন কবি গানের আসরেসেটি হবে কবি গানের পাঠশালা। কবিয়াল রমেশ শীল ফণী বড়ুয়া এবং রায় গোপাল দাশের মতো যোগ্য এবং সদর্থক শিষ্যদের নিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কবিগানের বিজয় কেতন উড়িয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে কবি গানের ধারায় রমেশ শীল যদি হন ‘পত্রবহুল সতেজ বৃক্ষ তাহলে ফণী বড়ুয়া সুবাসিত পুষ্প’’ যা এখনো বাঙালিকে মুগ্ধ করে রেখেছে।

বাংলা কবিগানের গতানুগতিক ধারার ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিলেন কবিয়াল রমেশ শীল। রমেশ শীল মাইজভান্ডারের ভক্ত ছিলেন ফণী বড়ুয়া তাঁকে মাইজভান্ডারের ভূবন থেকে দেশভান্ডারে প্রবেশ করালেন।’’ অষ্টাদশ শতকের বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য কবিগানের উদ্ভব ঘটে। ফলে শুরুতে কবিগান ছিল কুরুচিপূর্ণ, স্থুল, বিকৃত, কখনো অলৌকিক দেব দেবীর মাহাত্ম বর্ণনা। উনিশ শতকের প্রথম দিকে কবিগান কিছুটা অশ্লীলতা থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে বাস্তববাদের উত্থান ঘটে। কবিগান সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। পূর্ববঙ্গে কবিগানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। শুরুতে প্রথাগত দেবদেবীর বন্দনা ছেড়ে দেশ, দেশের বরণীয় সন্তান, কবি সাহিত্যিক, সংগ্রামী মানুষদের বন্দনা দিয়ে শুরু হয়। কবিগানে আর্থ সামাজিক রাজনীতি, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সচেতনতা প্রাধ্যন্য পায়। নতুন ধারায় গাওয়া হলো “প্রথমে বন্দি আমি জননী জন্মভূমি, কবি শিল্পী, সাহিত্যিকগণে, যারা স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে করে জীবন পণ। স্বাধীনতার যুদ্ধ করি সূর্যসেন গিয়াছে মরি, স্মরণ করি ক্ষুদিরাম। গুরু রমেশ শীলকে স্মরি ভাসাইলাম গানের তরী। জানাই তাঁহার চরণে প্রণাম।’’

শ্রোতারা শুনলেন নতুন ধরনের উপস্থাপনা, জীবনঘনিষ্ঠ, সমসাময়িককালের অবস্থা, দেশপ্রেমের কথা। গাইলেন ‘আগুন লেগেছে সুখের ঘরে এখনো রয়েছো ঘুমের ঘোরে, চল্লিশ কোটি ভারতবাসী মরার মতো বেঁচে আছি উপবাসী জীর্ণ কলেবরে’। গান শুনে কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্কিম সেন কবিগানকে গণজাগরণের হাতিয়ার করলেন। তাঁরা অর্থের পিছনে ছুটেননি। কবিগানে শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলবার জন্য, গণ মানুষের মুক্তির কথা বলবার জন্য, কুসংস্কার, বঞ্চনা শোষণের কথা বলবার জন্য কবিয়ালগণ এসকল বিষয়কে কবিগানের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন। ‘একালসেকাল’ ‘যুদ্ধশান্তি’ ‘ধর্ম বিজ্ঞান’ ‘স্বৈরতন্ত্রগণতন্ত্র’ ‘ধনতন্ত্রসমাজতন্ত্র’ ইত্যাদি হোল কবিগানের বিষয়।

আমৃত্যু কবিগানের মাধ্যমে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন ফনি বড়ুয়া। কবিগান কেবল মনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়। বৃটিশ বিরোধী বামপন্থীদের উদ্যোগে চট্টগ্রামে প্রথম কবিয়ালদের সংগঠিত করার চেষ্টা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৩ এ ফনিবাবু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। কমরেড আবদুস সাত্তার ছিলেন তাঁর প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু। তাঁর সাহচর্যে ফনীবাবু প্রগতিশীল রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হন। তাছাড়া মাস্টারদা সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তীর বৈপ্লবিক কর্মকান্ড তাঁর মনে প্রেরণার সৃষ্টি করে। তাই তিনি স্বাধীনভাবে কবিগানের মুখবন্ধে রাজনৈতিক বিষয় ও দেশপ্রেমমূলক বক্তব্য রাখার তাগিদ অনুভব করেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল কবিগানকে চটুল স্থুল মনোরঞ্জনের গন্ডি থেকে মুক্ত করে জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের হাতিয়ার করে তোলা। সে সময় কবিগানে স্বদেশ প্রীতি এবং ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্থলে উদার মানবিকতার হাওয়া লেগেছিল। ১৯৪৩ সালে রমেশ শীলকে সভাপতি করে ফণী বড়ুয়াকে সম্পাদক করে “চট্টগ্রাম কবি সমিতি” গঠিত হয়। এ সময় চট্টগ্রামের কবিগানের স্বাতন্ত্র ও নতুনত্ত্ব তথা কবিগানের নতুন ধারার প্রতি বঙ্গীয় সারস্বত সমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৯৪৫ এ নিখিল বঙ্গ প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে রমেশ শীলফণী বড়ুয়া জুটি পশ্চিম বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল শেখ গোমানি ও লম্বোদর চক্রবর্তীকে কবির লড়াইয়ে পরাজিত করেন। রমেশ শীল ও ফণী বড়ুয়া এ দুটি নাম লোক সংস্কৃতির জগতে দুটি আলোক ভরা জ্যোতিষ্ক । কবিগানের যুগ স্রষ্টা রমেশ শীলের সাথে যে নামটি অবলীলায় উচ্চারিত হয় তা হোল ফনী বড়ুয়া। রমেশ শীলের ঐতিহ্য ও আদর্শকে সমুন্নত রাখতে ফণী বড়ুয়া আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। বাংলার কবিগানে এবং নতুন যুগের কবিগানে রমেশ শীলের পরেই ফনি বড়ুয়ার স্থান। তাঁদের হাতে কবিগান হয়ে উঠে সমাজ ভাঙ্গার গান। কবিগানের এ নতুন পথের জন্য কবিদের জানতে হয় চলমান বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে। এছাড়া সাধনা করতে হয় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য ও মাকর্সবাদ সম্পর্কে। আমৃত্যু কবিগানের মাধ্যমে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানের উভয় অংশের বৈষম্য সম্পর্কে তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে: ‘পাকিস্তানের এক নদীতে গতি দুপ্রকার পূর্ব দিকে ভাটা শুধু পশ্চিম দিকে জোয়ার।’ ধর্মান্ধতা সম্পর্কে ব্যক্ত করেছেন, “মদের নেশা! গাজার নেশা! ধরলে মাথা ছাড়ে, ধর্মের নেশা ধরলে মাথা অন্ধকুপে মরে, আর কি তারে ছাড়ে’’। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা বিষয়ে লেখেন– ‘ধর্ম নিয়ে কর্মজীবন হবে না গঠন, বাঁচার মতো বাঁচতে হলে মুক্ত বুদ্ধির প্রয়োজন।’ স্বদেশ প্রীতি, সমাজ সচেতনা, গভীর জীবনবোধ, উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক বাহক এ মানুষটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘‘একুশ পদক’’এ ভুষিত হয়েছেন ২০০০ এ। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে প্রথম প্রকাশিত বই ‘দেশের ডাক’। এছাড়া তিনি ‘হালজমানার গান’ ‘জনতার গান’ ‘সর্বহারার গান’ সহ বহু কবিতাও লিখেছেন। শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ বেদনার ছবি এঁকেছেন তিনি। শুধু নিজের দেশের জন্য নয়, বিশ্বের নিপীড়িত, ক্ষুধার্ত, বঞ্চিত জনগণের জন্য তিনি লিখেছেন অপরিসীম মমতায়। তাঁর সৃষ্টি সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা নিতে হবে। কবি গানকে কিছুতেই বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না। জনগণের কথা যারা বলেন তাঁরাই যথার্থ মানুষ। শত প্রতিকূলতার মধ্যে আদর্শকে সমুন্নত রাখবার দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর জীবনাদর্শ থেকে যদি সমাজ গ্রহণ করতে পারে তবেই তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। ২০০১ এর ২২ জুন এ মহান কবিয়ালের জীবন অবসান হয়। জীবন ঘনিষ্ঠ এ কবির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধসুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত তেলাওয়াতের ফজিলত ও আমল