যেকোনো অন্যায় কাজে ‘না’ বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে

মাদকবিরোধী যুব সমাবেশে আজাদী সম্পাদক

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

মাদকের বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনা। সর্বনাশা মাদক ধ্বংস করে মানুষের শরীর, মন, জ্ঞান-বিবেক ও তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তার পরিবারের সব স্বপ্নকে এবং তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে। মাদকের কালো থাবা ধ্বংস করে একটি সমাজকে, একটি জাতিকে এবং পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এটি বৃহৎ আকার ধারণ করে একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। তরুণ তাজা প্রাণের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে সমাজ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নগরীর মোটেল সৈকতে মাদক ও সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে আয়োজিত যুব সমাবেশে আলোচকবৃন্দ এ শঙ্কার কথা জানান। পাশাপাশি ভয়াবহ এ সংকট থেকে উত্তরণে তরুণ ও যুব সমাজকে বাঁচাতে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি ও মোটিভেশনাল প্রোগ্রামসহ মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, তরুণ ও যুবসমাজের মনে মাদকের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। মাদক পাচারের সাথে সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মাদক পাচার রোধ ও মাদকের সহজপ্রাপ্যতা বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
‘জাগি প্রাণের উচ্ছ্বাসে, গড়ি মাদক মুক্ত সোনার বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে যুব সমাবেশের আয়োজন করে কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘স্মাইল প্রকল্প’। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন কারিতাস বাংলাদেশের পরিচালক (কর্মসূচি) জেমস গোমেজ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, মাদকের করাল গ্রাস সম্ভাবনাময় তরুণদের অন্ধকারে নিয়ে যায়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষায় সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করে জাতির অগ্রযাত্রায় শামিল করতে হবে। তিনি উপস্থিত কিশোর-তরুণদের উদ্দেশে বলেন, সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে চরিত্র ঠিক রাখতে হবে। কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না। একমাত্র মা-বাবা আর শিক্ষকগণ নিঃস্বার্থভাবে তোমাকে সাহায্য করবে।
যেকোনো অন্যায় কাজে ‘না’ বলার অভ্যাস গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মাদকের বিষয়ে তোমার বন্ধুকে অবশ্যই না বলবে। পাশাপাশি তাকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। তবেই এ ধরনের অনুষ্ঠান সার্থক হবে। তিনি আরও বলেন, একটা শিশুর জন্ম হলে সে কান্না করে আর সকলে হাসতে থাকে। এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে এমন কিছু করে যাওয়ার চেষ্টা করো, যেন তোমার জন্য সকলে চোখের জল ফেলে। অন্যের জন্য সেবার হাত প্রসারিত করার মাধ্যমে একজনের মুখেও যদি হাসি ফুটাতে পারি, তবেই এ জীবন অর্থবহ হয়ে উঠবে। জীবনের মূলমন্ত্র হলো ভালো কাজ করা। অতীত বা ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে হবে।
এম এ মালেক বলেন, সম্মান জোর করে পাওয়া যায় না। আমি বসার পর এ চেয়ার যেন সম্মানিত বোধ করে; সে লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। যুগের সাথে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কাজ করে যেতে হবে। তোমাদের মধ্যে যে স্ফুলিঙ্গ লুকিয়ে আছে, চেষ্টা করতে হবে তা যেন অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলে ওঠে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারি জনতার উদ্দেশে বলেন, এ সমাজে বাস করছেন, আপনারও কিছু দায়িত্ব আছে। মাদকের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। মাদকের বিরুদ্ধে আমরা মাঝি হিসেবে হাল ধরেছি। এ নৌকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনাদের মাল্লা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার নিতাই কুমার ভট্টাচার্য বলেন, জাতির জনক মাদকের ছোবলে আক্রান্ত বাংলাদেশ দেখতে চাননি। তিনি একটি সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। মাদকের নেশার চক্রব্যুহে ঢোকা সহজ, কিন্তু বেরুনো কঠিন। এ কঠিন কাজটি সহজে করতে যার যার অবস্থান থেকে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
দুই বার এভারেস্ট জয়ী বাংলাদেশি এম এ মুহিত বলেন, তরুণ-যুবকদের লক্ষ্য থাকতে হবে, স্বপ্ন থাকতে হবে। লক্ষ্য পূরণের জন্য মানসিকভাবে দৃঢ়চেতা হতে হবে। কিন্তু মাদক, নেশাদ্রব্য সেই লক্ষ্য পূরণে বড় বাধা। এজন্য তরুণ-যুবসমাজকে মাদক পরিহার করতে হবে। আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে হবে। সেটা একেবারে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করতে হবে। মাদকের বদভ্যাস যেন কোনোভাবেই না হয়, সেই চর্চা ছাত্রজীবন থেকে করতে হবে। নিজেকে, আশপাশের মানুষকে, বন্ধু-সহপাঠীদের মাদকের মরণ ছোবল থেকে রক্ষার দায়িত্বও পালন করতে হবে। তবেই জীবনের যেকোনো লক্ষ্য জয়ে সফল হওয়া যাবে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা এভারেস্ট আছে। সেটা হলো লালিত স্বপ্ন। স্বপ্নের শিখরে পৌঁছাতে হলে মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। কথাসাহিত্যিক বাদল সৈয়দ বলেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই। মাদক মানুষকে সুস্থভাবে ভাবতে দেয় না, বাঁচতে দেয় না। মাদক শুধু মানুষকে বিপথগামীই করে না, বরং মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে নিয়ে যায়। মাদকের ছোবল থেকে তরুণ ও যুবসমাজকে বাঁচাতে হবে।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দীন বলেন, অনেকে মাদকের বিরুদ্ধে বলেন, কিন্তু কাজ করতে গেলে পুলিশকে সহযোগিতা করতে চান না। এক্ষেত্রে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এমনও দেখা গেছে, মাদক ধরেছি, মামলা হয়েছে। সাক্ষী পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে যান না। চট্টগ্রামে একটা মানসম্পন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্র নেই। ২০১৮ সালে আমি সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছিলাম একটি আধুনিক মানসম্পন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তুলতে। মাদক নির্মূলে অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। আমার শহরে প্রতি তিন হাজার লোকের জন্য একজন পুলিশ রয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ সবকিছু করে ফেলবে এ আশা করাটা অযৌক্তিক।
বেসরকারি কারা পরিদর্শক অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, একজন মাদকাসক্ত শুধু পরিবার নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হচ্ছে। কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না, যদি মাদককে নির্মূল করা না যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন নয়, মাদক নির্মূল আইন চাই।
সমাবেশের আগে নিউ মার্কেট চত্বর থেকে মাদকবিরোধী পদযাত্রা হয়। সমাবেশে মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক নাটিকা, মাদক যুদ্ধে জয়ীর জীবনালেখ্য পরিবেশন এবং মাদকমুক্ত থাকার শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। সমাবেশে কারিতাসের স্মাইল প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন কর্মসূচি কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম চৌধুরী।
বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা, কারিতাস লুঙ্মেবার্গের কান্ট্রি ম্যানেজার সুবাস চন্দ্র সাহা, বাতিঘরের প্রতিষ্ঠাতা দীপঙ্কর দাশ, নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর শাহীন আক্তার রোজী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেহজারিন বিনতে গাফফার এবং মাদকযুদ্ধে জয়ী জাহিদ হাসান দোলন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় নতুন ২ পৌরসভার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে
পরবর্তী নিবন্ধমানবতার কল্যাণে আমরা উত্তর জেলার পুনর্মিলনী