যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার–পরিজন ও সমগ্র সাথী–সঙ্গীদের ওপর।
পবিত্রতা, বদান্যতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মাস মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ মাসে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলী বিকশিত হয়। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি বিত্তবানদের দয়া, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জাগ্রত হয়। তাই মাহে রমজানকে হাদিস শরিফে রাসুল (সা.)-বলেছেন শাহরুল মুওয়াসাত বা সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মাস।
সিয়াম সাধনা বা রোজা পালন সমাজে সাহায্য–সহযোগিতা, সমবেদনা তথা সহমর্মিতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। সমাজ জীবনে রোজাদার ধনী–গরিব ব্যক্তি মিলেমিশে ইবাদত করে একত্রে সমাজবদ্ধ হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেন। প্রকৃত রোজাদার সমাজের কাউকে ঠকাতে বা কারও সঙ্গে প্রতারণা করতে পারেন
না। রোজাদার কারও অনিষ্ট, অকল্যাণ ও ক্ষতিসাধন করবেন না ; বরং মাহে রমজানে সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র, দুর্বল, পীড়িত, অসুস্থ, অনাথ, ছিন্নমূল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত নিরন্ন মানুষের খোঁজখবর রাখবেন, তাদের খাওয়া–পরার ব্যবস্থা করবেন, সেহ্রি–ইফতারের আয়োজন করবেন, যথাসম্ভব সাধ্য
অনুযায়ী পরোপকারে ব্যস্ত থাকবেন। ধনী–গরিব আপামর রোজাদার এভাবে রোজার মাসে অসাধারণ ত্যাগ–তিতিক্ষার অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হন। প্রকৃত রোজাদার ও ইমানদার ধমপ্রাণ ব্যক্তিরা সব সময়ই অসৎ কাজকর্ম থেকে দূরে থেকে বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের প্রতি পারস্পরিক সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
মাহে রমজান সামাজিক ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানে এবং একটি সংঘাতমুক্ত গঠনমূলক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বিশেষ করে, সমাজে রোজাদারদের পারস্পরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রমজান মাসের রোজার ভূমিকা অপরিসীম। সমাজে ধনী–গরিব, দুঃখী–
বুভুক্ষু, অনাথ–এতিম বিভিন্ন ধরনের মানুষ বসবাস করেন। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার পরিহার করার ফলে গরিব–দুঃখীদের অপরিমেয় দুঃখ–কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখেন। এভাবে ধনী লোকেরা অতি সহজেই সমাজের অসহায় গরিব–দুঃখী, এতিম–মিসকিন ও নিরন্ন
মানুষের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে তাদের জন্য সেহ্রি ও ইফতারের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দান–খয়রাত, জাকাত–সাদকা প্রদানসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য–সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। নবী করিম (সা.)-যথার্থই বলেছেনএ মাস (রমজান) সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস।
সমাজে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মাহে রমজানের রোজার যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের যে সম–অধিকার রয়েছে, প্রকৃত রোজাদার ব্যক্তি তা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমাজের গরিব মানুষের প্রতি খুবই সদয় ব্যবহার করেন। কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অসদাচরণ ও অন্যায়–অপরাধ
করেন না। রোজাদার ব্যক্তি সবাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাম্যের জয়ধ্বনি করেন। সমাজের শ্রমজীবী খেটে খাওয়া সম্বলহারা মানুষ যাতে মাহে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য ধনী–সামর্থ্যবান রোজাদারেরা দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন। মালিকেরা
শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, অগ্রিম বেতন–ভাতা প্রদান ও কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেন। এভাবে মাহে রমজানের দিনে অধীনস্থ শ্রমিক, কর্মচারী এবং চাকরবাকরদের দায়িত্ব ও কাজকর্ম হালকা করে দেওয়া উচিত। এ মাসে তাদের ওপর কষ্টকর সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপানো সম্পূর্ণ অনুচিত, এটা
অমানবিক বটে। কারণ তারাও রোজাদার, রোজা রেখে তারা অধিক কষ্টসাধ্য কাজ করলে বেশি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ব। তাই কঠিন ও সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপিয়ে যাতে তাদের অধিক কষ্ট দেওয়া না হয়, সেদিকটি অবশ্যই মানবিক বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমনভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)- বলেছেন এ মাসে
(রমজানে) যারা দাস–দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেন, অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করেন আল্লাহ তাদের দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন।
রমজান মাসে কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তিরা অপরের বদনাম ও কুটনামি থেকে বিরত থাকেন। তারা সকল প্রকার ঝগড়া–বিবাদ, ফিতনা–ফ্যাসাদ, অযথা বাগ্বিতণ্ডা ও যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। তাদের মুখ থেকে কোনো প্রকার অশ্লীল কথা বের হয় না। যদি কোনো রোজাদার
লোককে কেউ গালিগালাজ ও ঝগড়া–বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় তখন সেই রোজাদার যদি উত্তেজিত না হয়ে ঝগড়া–বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে দূরে সরে যান, তাহলে সমাজে শান্তি–শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় না এবং একটি আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠে। নবী করিম (সা.)- সতর্ক করে দিয়েছেন যখন
তোমাদের কেউ কোনো দিন রোজা রাখে তখন তার মুখ থেকে যেন কোনো রকম খারাপ কথা ও শোরগোল বের না হয়। যদি কেউ তাকে গালিগালাজ করে বা ঝগড়া–বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় তখন সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার ব্যক্তি।
মাহে রমজানে সমাজের স্থিতিশীলতা,শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি মাহে রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি–ধর্ম–বর্ণ ও দলমতনির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনো রকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না।
তাই সমাজ জীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য–সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এবং সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাসব্যাপী রোজাদার ধনী লোকেরা গরিবের দুঃখ–কষ্ট এবং অনাহারের জ্বালা মর্মে মর্মে অনুভব করে স্বভাবতই সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র
ও দুঃস্থদের প্রতি অত্যন্ত সদয় আচরণ করেন। এ ছাড়া সারা বছরই হতদরিদ্র ও আর্তমানবতার প্রতি সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ মাহে রমজানের মহান শিক্ষা।
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সুসংবাদ নিয়ে এল মাহে রমজান। প্রিয় নবী (সা.)-বলেন, যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের নিয়তে রমজানে রোজা পালন করে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের আশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
রোজাদার কারও অনিষ্ট, অকল্যাণ ও ক্ষতিসাধন করবেন না; বরং মাহে রমজানে সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র, দুর্বল, পীড়িত, অসুস্থ, অনাথ, ছিন্নমূল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত নিরন্ন মানুষের খোঁজখবর রাখবেন, তাদের খাওয়া–পরার ব্যবস্থা করবেন, সেহ্রি–ইফতারের আয়োজন করবেন, যথাসম্ভব সাধ্য অনুযায়ী পরোপকারে ব্যস্ত থাকবেন। মাহে রমজানে দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শন।
রোজাদারদের সম্মিলিত সাহায্য–সহযোগিতা ও সহমর্মিতা অনেক অসহায় মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে। ফলে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাতে নিপতিত অনেক অনাহারী মানুষ ক্ষুধা–তৃষ্ণার অসহনীয় দুর্ভোগ থেকেও মুক্তি পাবে। মাহে রমজান যেন সমাজের ধনী–গরিব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা গড়ে ওঠার
অবলম্বন হয় এবং সমাজ থেকে যেন সব ধরনের দুঃখ–কষ্ট, অরাজকতা–অনাচার দূরীভূত হয়, মানুষ যেন সত্য, সুন্দর ও মুক্তির পথ খুঁজে পায়। এ জন্য রমজান মাসে মুসলিম সমাজে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা আরও বৃদ্ধি করে সর্বাবস্থায় পরহেজগারি অবলম্বন করা উচিত।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট