বাংলা সংগীতের প্রবাদপ্রতীম কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে। কেবল বাংলা নয়, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠী, ভোজপুরী, পাঞ্জাবি, কানাড়া, অসমিয়া প্রভৃতি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানও। তবে তাঁর গানের ভুবন তৈরি হয়েছিল মূলত বাংলা গানের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে।
মান্না দে’র প্রকৃত নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। জন্ম ১৯১৯ সালের ১মে কলকাতায়। কাকা সংগীতাচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে ছিলেন তাঁর গানের গুরু, শিক্ষক ও আদর্শ। ওস্তাদ দবির খান, ওস্তাদ আমান আলি খান, ওস্তাদ আবদুর রহমান খান প্রমুখের কাছেও তালিম নিয়েছেন তিনি। কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন মান্না দে। কলেজে পড়ার সময় গান গেয়ে সহপাঠীদের মাতিয়ে রাখতেন। কলেজের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বরাবরই প্রথম স্থানটিও ছিল তাঁরই দখলে। ১৯৪২ সালে কাকার সাথে বোম্বে যান মান্না দে। এ সময় স্বনামধন্য অনেক গীতিকার ও সুরকারের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ শুরু করেন। জীবনের দীর্ঘসময় মান্না দে বোম্বেতে কাটিয়েছেন। কলকাতাতেও ছিলেন অনেকটা সময়। ১৯৪২ থেকে ১৯১৩ – এ সময়কালে প্রায় চার হাজার গান গেয়েছেন শিল্পী। উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে সুরের মায়াজালে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন। তাঁর গাওয়া বাংলা গানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগের সুরকার শিল্পী নিজে। মান্না দে’র গানে সহজ, ঘরোয়া, মানবিক আবেগ প্রধান উপজীব্য। সুরও গানের সাথে মিলেমিশে একাকার। তাঁর প্রেমের গানে বিষণ্নতার এক অতুলনীয় রূপ ফুটে ওঠে। কথা ও সুরের অপূর্ব মেলবন্ধন আর অতুলনীয় গায়কীতে তা হয়ে ওঠে অসাধারণ কাব্য। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার অর্জন করেন শিল্পী। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন সম্মানসূচক ডিলিট। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ও তাতে অংশ নেন। তাঁর গান বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর প্রয়াত হন শিল্পী মান্না দে। প্রবাদপ্রতীম এই শিল্পীর মহাপ্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলা সংগীতের এক স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে।