জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ভেদাভেদ ছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহতদের সাহায্য, যে কোন স্থানে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা উপশম প্রতিকার করার উদ্দেশ্য থেকেই রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের সৃষ্টি। রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলন জাতি, উপজাতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, শ্রেণী কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসে কোন প্রকার বৈষম্যের সৃষ্টি করে না। একমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে ব্যক্তির যন্ত্রণা দূর করা এবং জরুরী অবস্থায় বিশেষ দুর্দশাগ্রস্থের সেবায় অগ্রাধিকার দানের প্রচেষ্টা চালায়। বিশ্বব্যাপী এর রয়েছে সার্বজনীন স্বীকৃত নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্যতা। যা সংগঠনের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে তুলেছে।
যে সকল মানুষ তাদের ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব ও কর্মপন্থা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন জ্বীন হেনরী ডুনান্ট তাদের মধ্যে অন্যতম। রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জ্বীন হেনরী ডুনান্ট এর জন্ম ১৮২৮ সালের ৮ই মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের রু-ভারদেইনি নামক স্থানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা জ্বীন জ্যাকুয়াস ডুনান্ট ছিলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও একজন সক্রিয় সমাজকর্মী। মা এন্টো ইনেট ডুনান্ট ছিলেন একজন উদারনৈতিক চরিত্রের ধার্মিক মহিলা। ডুনান্টের চরিত্র গঠনে তার মায়ের ছিল প্রভাব অপরিসীম।
জ্বীন হেনরী ডুনান্টের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় অন্য শিশুদের তুলনায় বেশ আগে। মানবিক মূল্যবোধের দীক্ষাও নেন অতি অল্প বয়সে। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি কৈশোরেই নিজের ভূমিকা সুস্পষ্ট করেন। বালক ডুনান্ট ফ্রান্সের সমুদ্র নগরী টুলন ভ্রমণে গিয়ে পরিদর্শন করেন সেখানকার জেলখানা। দেখতে পান বন্দিদের নানা দুর্দশা, অনুভব করেন বন্দিত্বের কষ্ট। সহানুভূতিশীল ডুনান্ট এরপর নিয়মিত জেলখানায় যেতেন এবং বন্দিদের চিঠি লেখা দেয়া সহ বিভিন্ন রকম সাহায্য সহযোগিতা করতেন।
১৮ বছর বয়সে জ্বীন হেনরী ডুনান্ট Geneva Society for Alms Giving নামক একটি সেবা সংগঠনে যোগ দেন। একই বছর বন্ধুদের নিয়ে গঠন করেন Thursday Association নামে একটি সেবা সংস্থা। ব্যাংকিং ব্যবসা শেখার জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে মুদ্রা বিনিময়করী প্রতিষ্ঠান Lullinet Sautter-G যোগ দেন ১৮৪৯ সালে। এর সফল পরিসমাপ্তির পর তিনি একজন ব্যাংকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৮৫২ সালে ৩০শে নভেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন Young Men’s Christian Association (YMCA) এর জেনেভা শাখা এবং তারই প্রচেষ্টায় প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় এই সংগঠনের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
১৮৬৭ সালেCredit Genevois নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার নামে দেউলিয়াত্বের অভিযোগ আনে। তখন তার বয়স মাত্র ৩৯ বছর। ১৮৮৭ সালে জুলাই মাসে ৫৯ বছর বয়সে জ্বীন হেনরী ডুনান্ট ফিরে আসেন নিজ দেশের হেইডেন শহরে। ১৮৯২ সালের ৩০শে এপ্রিল ৬৪ বছর বয়সে দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও বয়সের ভারে দূর্বল শরীর নিয়ে তিনি ভর্তি হন একটি নার্সিং হোমে এবং জীবনের শেষ ১৮ বছর এখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৮৯৫ সালে হেইডেন শহরে ভ্রমণে আসা এক সাংবাদিক ডুনান্টের সাক্ষাৎকার নেন এবং ফিরে গিয়ে Die Ostchweiz পত্রিকায় Dunant, the founder of the Red Cross’’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। বিশ্ব শান্তি ও মানবিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ১৯০১ সালে Peace League প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডারিক পেসির সাথে যৌথভাবে শান্তির জন্য প্রবর্তিত প্রথম নোবেল পুরস্কারে অলংকৃত করা হয়। এরপর ১৯০৩ সালে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি তাকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১০ সালের ৩০শে অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে লাখো মানুষের বেদনা আর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে জ্বীন হেনরী ডুনান্ট চলে গেলেন অমৃতলোকে।
যে ভাবে জন্ম হয় রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট : ১৮৫৯ সালের ২৪শে জুন উত্তর ইতালির সলফেরিনো নামক স্থানে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য হতাহত হয়। আহত সৈন্যরা বিনা চিকিৎসায় যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। সেই সময় সুইজারল্যান্ডের এক যুবক জ্বীন হেনরী ডুনান্ট ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেথে তিনি ব্যথিত হন এবং তিনি আশেপাশের গ্রামবাসীকে ডেকে এনে আহতদের তাৎক্ষণিক সেবা ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরাই রেড ক্রসের প্রথম স্বেচ্ছাসেবক, যাদের অধিকাংশ ছিলেন মহিলা। ডুনান্ট এই যুদ্ধের ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় স্মৃতি ও তার প্রতিকারের জন্য ১৮৬২ সালে “এ মেমোরি অব সলফেরিনো” নামে একটি বই রচনা করেন। বইটির মূল কথা ছিল “আমরা কি পারিনা প্রতিটি দেশে এমন একটি সেবা সংগঠন গঠন করতে যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকল যুদ্ধাহতদের সেবা করবে?” ১৮৬৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি জীন হেনরী ডুনান্ট চারজন জেনেভাবাসীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন, যা “কমিটি অব ফাইভ” নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এই কমিটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি নামে পরিচিত হয়। একই বছর এই কমিটি ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জেনেভায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। সম্মেলনে ডুনান্টের মহতি প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয় এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে রেড ক্রস জন্ম লাভ করে। ১৯৪৮ সালের ৮ই মে রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা জ্বীন হেনরী ডুনান্টের জন্ম বার্ষিকীতে সারা বিশ্বে প্রথমবারের মত রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস পালন করা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে দিনটি “বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস” হিসেবে উদযাপন হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতি : আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতি ৭টি। যথা: ১. মানবতা, ২. পক্ষপাতহীনতা, ৩. নিরপেক্ষতা, ৪. স্বাধীনতা, ৫. স্বেচ্ছামূলক সেবা, ৬. একতা, ৭. সার্বজনীনতা। ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ২০তম আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সম্মেলনে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতিসমূহ গৃহীত হয় এবং ১৯৮৬ সালে ২৫তম আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সম্মেলনে মূলনীতিসমূহ সংগঠনের সংঘবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি : ওঈজঈ রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা প্রতিষ্ঠান যা ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট নীতিমালার অভিভাবক। ওঈজঈ এর মূল পরিচালনা পর্ষদ শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ডের নাগরিকদের নিয়ে গঠিত যার সদস্য সংখ্যা ২৫ জনের বেশি হবে না।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ : আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সাহায্য সংস্থা। যারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি বা রাজনৈতিক মতাদর্শীদের কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা প্রদান করে। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটির বর্তমানে ১৮৬টি জাতীয় রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সদস্য রয়েছে। যার সদর দপ্তর হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। জাতীয় সোসাইটি সমূহের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দিক নির্দেশনা প্রদান করাই হচ্ছে ‘আই.এফ.আর.সি.’ এর প্রধান কাজ।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি : ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর সরকারের সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ৩১শে মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতির এক আদেশবলে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটিকে ‘আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি’ স্বীকৃতি প্রদান করে। একই সময়ে সোসাইটি তৎকালীন লিগ অব রেড ক্রসের সদস্য পদ লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল রাষ্ট্রপতির আদেশবলে বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির নাম পরিবর্তন করে ‘রেড ক্রিসেন্ট’ করা হয়।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আহত ও অসুস্থ সৈন্যদের সেবা-শুশ্রূষা করা, মানুষের দুর্ভোগ লাঘব ও অবস্থার উন্নতি করা, সকল জাতির মধ্যে শান্তি স্থাপন ও তা বজায় রাখা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ ও উপশমের ব্যবস্থা করা, মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা, নার্সিং ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মাতৃ ও শিশুমঙ্গল প্রতিষ্ঠা পরিচালনা করা, দেশের যুব সমাজকে সুসংগঠিত করা, এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনা করা, হাসপাতালে রোগীদের কল্যাণে নিত্য ব্যবহার্য ও উপহার সামগ্রী সরবরাহ করা, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে এর উদ্দেশ্য অর্জন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাথে জাতীয় পর্যায়ের সমন্বয় করা, সোসাইটি কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সেবা কার্যক্রমের অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কোভিড-১৯ কার্যক্রম। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মাঠে থেকে প্রতিরোধ করার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। কোভিডে জীবাণুনাশক স্প্রে করণ কার্যক্রম, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি, রান্না করা খাবার বিতরণ, ফুড প্যাকেজ বিতরণ, সবজি বিতরণ, পানীয় বিতরণ ও শুধু তাই নয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড- নন কোভিড রোগীদের অঙিজেন সেবা প্রদান করা হয়েছে। ফ্লু কর্ণার ও ইনভেস্টিগেশন সেল কার্যক্রমে নন কোভিড রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণের মাধ্যমে সেবা পরিচালনা করা হয়।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব করে না। অথবা জাতিগত, আদর্শগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কোন প্রকার মতবিরোধে সামিল হয় না। এটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে জন্ম লগ্ন থেকেই। এটি একটি মানবসেবী সংগঠন।
লেখক : চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন