বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্য। সেই মহাকাব্যের কবি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহাকাব্যের সূচনা বাঙালির জাতীয়তাবোধের উন্মেষকাল থেকেই যার চরম বহিঃপ্রকাশ ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বাংলাদেশ একটু একটু করে বদলে যায়। সূচনা হয় সশস্ত্র সংগ্রামের। ৩রা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একায় আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। পরবর্তী কোন একসময় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে বলে তিনি তাঁর ঘোষণায় উল্লেখ করেন।
পূর্ব বাংলার জাতীয় দৈনিকগুলো ও রেডিওতে ঘোষণা শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র–ছাত্রী দলে দলে ক্লাস থেকে হল থেকে বের হয়ে বটতলায় জড়ো হয়। ছাত্রলীগ আর ডাকসুর নেতারা ঠিক করে বিকাল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা করবে। ঢাকা পরিণত হয় একটি বিক্ষুদ্ধ মিছিলের নগরীতে। সভায় তোফায়েল আহম্মদ, আবদুল মান্নান, সিরাজুল আলম খান, আসম আবদুর রব ও নুরে আলম ছিদ্দিকী প্রমুখ। ছাত্র–ছাত্রী ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এ সভায় বক্তৃতা করেন এবং জনগণকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও নির্দেশ মত আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিকাল বেলা পূর্বাণী হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন ২ মার্চ ঢাকা শহরে ও ৩ মার্চ সমগ্র দেশে অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী ঘোষিত হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার নির্দেশ প্রদান করেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ নুরে আলম ছিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব, আব্দুল কুদুস মাখন চারজন বিকেলে এক গোপন বৈঠকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। সংবাদপত্রে দেশের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কোনও খবর প্রকাশ করা যাবে না এই মর্মে ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করা হয়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সকাল থেকেই শহরে শত শত বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সমগ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস আদালত, ব্যবসা কেন্দ্র দোকানপাট হরতালের সমর্থনে বন্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্র সমাবেশে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন আসম আবদুর রব এবং এই পতাকার পরিকল্পনা ও অংকন করেন শিল্পী শিবনারায়ন দাশ। যেকোনও ত্যাগ শিকার করে এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়া হয়।
হঠাৎ করে বেতারে সামরিক সরকার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৩ মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে। একথা শোনার সাথে সাথে বিভিন্ন ছাত্রাবাসে, শ্রমিক এলাকায় এবং মহল্লা থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। তাদের স্লোগান ছিল সান্ধ্য আইন মানি না, মানবো না। ‘জয় বাংলা’ বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
সমগ্র শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, বাঙালি তাদের অধিকার অর্জনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
৩রা মার্চ বন্দর নগরী চট্টগ্রাম মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মাঠে ৭১টি গুলিবিদ্ধ লাশ জমা হয়। ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টায় থেকে দুপুর ২টায় পর্যন্ত হরতাল পালনের ঘোষণা দেন এবং পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার ঘোষণা দেন। ছাত্রলীগ আয়োজিত ঐ জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাবাবেগপ্লুত হয়ে বলেন পল্টনের এ সভা আমার শেষ সভা হতে পারে। আমার অবর্তমানে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় যারা থাকবে তারাই সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন। তিনি সামরিক সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, তাদের মত যদি ৭ মার্চের আগে পরিবর্তন না ঘটে তবে ঐ দিনই ভবিষ্যৎ কর্মসূচী দেয়া হবে। ছাত্রলীগ আয়োজিত ঐ সমাবেশ থেকেই স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।
জেনারেল ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টরী গ্রুপের ১২ জন নেতাকে ১০ মার্চ ঢাকায় এক বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন নিরস্ত্র জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করে হচ্ছে শহীদের তাজা রক্ত তখনও রাজপথে শুকিয়ে যায়নি কতিপয় নিহত ব্যক্তির লাশ এখনও দাফন হয়নি। শতশত মানুষ যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে ঠিক সেসময় ১০ মার্চ প্রেসিডেন্টের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক তামাসা ছাড়া আর কিছু না। ৩ মার্চ থেকে প্রকৃত পক্ষে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি নিয়ে স্বায়ত্বশাসনের এদিন থেকে স্বাধীনতা সশস্ত্রভাবে এগিয়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কঠোর সামরিক প্রহরায় ঢাকা আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল ওমর, এম এম আহমদ, জি ডব্লিউ চৌধুরী সহ মূল সামরিক দলের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ।
পি.পি.পি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কেন্দ্রের মূল ক্ষমতা দেশের উভয় অংশের সংখ্যাগরিষ্ট পার্টির কাছে প্রাদেশিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। এই বিবৃতি সম্পর্কে পি.ডি.বি’র নেতা বলেন ভুট্টোর প্রস্তাব অবান্তর ও নৈরাজ্যজনক। আর প্রবীণ রাজনীতিক নেতা আবুল হাশেম একটু গর্জিয়ে বলেন, ভুট্টোর কথামত ইয়াহিয়া চললে পাকিস্তানের বিভক্তি অনিবার্য। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কাজে যোগদান সম্পর্কিত ১১৫নং সামরিক আইনের সমালোচনা করে বলেন, প্রত্যেক বাঙালিকে বাংলাদেশ রক্ষার জন্য অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। আসম রব বলেন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। আমাদের উপর সামরিক বিধি জারি করার ক্ষমতা কারো নেই। বাংলাদেশের জনগণ কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মেনে চলবে। আবদুল কুদ্দুস মাখন বলেন, দেশে যদি আইন জারি করতে হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান তা করবেন। এইদিন পিআইএ বোয়িং বিমান এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ১৩০ বিমানগুলো নিয়মিতভাবে সাজ সরঞ্জামসহ সেনা সদস্যদের নিয়ে আসতে থাকে। এজন্য কুর্মিটোলা বিমান বন্দরটি তখন একটি নিয়মিত বিমান যুদ্ধের ঘাটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সংগ্রামে চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানান। মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলে এক বিশাল জনসভায় বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া আপোষের আর কোনও পথ নেই। এদিকে করাচিতে এয়ার মার্শাল মো. আজগর খান এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চিত্রপট যেন আঁকেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য হাতে আর কয়েকদিন সময় আছে। যদি ঢাকায় আর ১টি গুলি চলে কিংবা সামরিক ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলেন, আপনি ঢাকায় যান এবং সেখানে গিয়ে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এইভাবে তাদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছিল আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, আপনারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আস্থা রাখুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচীর শেষ দিনে বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, যতদিন জনগণের অধিকার আদায় না হবে, ততদিন আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চেকপোস্ট বসায় যাতে এদেশ থেকে মূল্যবান সম্পদ পাচার হতে না পারে। এভাবে ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ৩য় খণ্ডে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি যা তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামে স্থানীয় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি তাঁর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। পাকিস্তানি সেনাদের আত্নসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন, যৌবনের ২৪ বছর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে ১৪ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল ‘৭১এর ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি বাঙালির।
লেখক: শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, দক্ষিণজেলা আওয়ামীলীগ