“সিল মারো রে ভাই সিল মারো-অমুক মার্কায় সিল মারো! দলে দলে লাইন ধরো— ভাইয়ের মার্কায় সিল মারো”! কিছু বুঝলেন? আই কিউ না-সাধারণ পরীক্ষা। আমাদের চলমান ভোগবাদী অপরাজনীতির ভয়ঙ্কর ক্ষয়ের ছোট্ট নমুনা মাত্র! মেধা- মননের ক্ষয়, বুদ্ধির ক্ষয় কত মারাত্মক হলে এমন হয়! নেতা সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন করবেন, তাঁকে নগরবাসী ভোট দেবে। এমনি এমনিতো আর দেবেনা, চাইতে হবে। নিজের প্রতীক ও ওয়াদা তুলে ধরে প্রচার করতে হবে। তাইতো চলছে। ভোট নিয়ে যাদের আগ্রহ শূন্য, তাদের হয়তো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। ধৈর্য্যের পরীক্ষা আর নয়।
এবার সিটি কর্পোরেশনের সব কেন্দ্রে নির্বাচন হবে ইভিএম মেসিনে। মেসিনের বোতাম আঙুলে টিপে ভোট দিতে হবে, ব্যালট পেপারে মার্কায় সিল মেরে নয়। তো, এটা ভোটারদের জানাবে কে? নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশন মোবাইল এসএমএসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ইভিএম মেসিনে ভোটের বিষয়টি প্রচার করছে। নানা কারণে ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। এটার দায়ও রাজনীতিক এবং কমিশনকে নিতে হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট উৎসবের আমেজ নিয়ে ভোটারদের আন্দোলিত করে। পাড়া, মহল্লা, দোকান, বৈঠকখানা নিজ নিজ দল ও প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা, তর্কের উত্তাপ ছড়ায়। উড়ে কাপের পর কাপ চা, ভারী হয় সিগারেটের ধোঁয়ার মেঘ। এবার করোনা সংক্রমণের কারণে সীমিত হয়ে গেছে প্রচারণা ও পাড়ার আড্ডা। তবুও বেলা দুটোর পর প্রার্থীসহ বা প্রার্থীর কর্মীরা রাজপথ, নগরীর অলি-গলিতে মিছিল, স্লোগান চালাচ্ছেন তুমুল। থাকি নগরকেন্দ্র কাজির দেউড়ি মোড়ের কাছে। বিকাল-সন্ধ্যায় মাইকে এমন ভুল স্লোগান মাঝে মাঝে কানে ঝাপটা খায়। ইভিএম মেসিনের নির্বাচন নিশ্চয়ই সব প্রার্থীর জানা। প্রচার কর্মীদেরও নিশ্চিত নির্দেশনা দিয়েছেন প্রার্থী বা তাঁর প্রচার সেল। তাহলে কেন এমন স্লোগান, সিল মারবেইবা কোথায়? আসলে এটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মেধা-মননের দীনতার সামান্য নমুনা।
করোনা আমাদেরসহ পুরো বিশ্বকে কঠিন শিক্ষা দিচ্ছে। সভ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশের সময় এমন পরীক্ষা বা শিক্ষা কেউ কল্পনাও করেনি। করোনার কাছে পুরোই অকেজো চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বছরের বেশি সময়েও করোনা নির্মূলে কার্যকর কোন ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। অঙিজেন সঙ্কট নিয়ে যে রোগী একবার হাসপাতালের কভিড ইউনিটে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছেন, তিনি জানেন এই সঙ্কট কত ভয়াবহ। ব্যয়বহুলতো বটেই। অথচ আমরা কতো নিষ্ঠুরভাবে ফ্রি অঙিজেন যোগানদাতা গাছপালা, সবুজ নিঃশেষ করে ফেলছি! হেসেখেলে ধ্বংস করছি প্রকৃতি-পরিবেশ। বাড়ি, ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ছি নদী, সাগর, পুকুর দিঘি দখল ও ভরাট করে। করোনা আমাদের বোধের রুদ্ধ কবাট খুলে দেয়ার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টো। লোভ, দখল, ভোগ আরও বাড়ছে। করোনা টিকা উদ্ভাবন হলেও এগুলো পূর্ণাঙ্গ কার্যকর কিনা, এখনও সন্দেহ অবিশ্বাস থেকেই যাচ্ছে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার সময় কভিড-১৯ নিঃসন্দেহে প্রকৃতির প্রতিশোধ। এই প্রতিশোধ এখানেই শেষ, ভাবলে চরম বোকামি হবে। করোনার পর আরো ভয়াল প্রতিশোধ আসবে না, পূর্বাভাস দেয়ার সাধ্য কারো নেই। ছোট্ট জীবনে একজন মানুষের কতো সম্পদ চাই? সচ্ছলভাবে খেয়ে-পরে সুখী নিরাপদ আবাসে বেঁচে থাকাইতো যথেষ্ট। এরচে’ বড় শান্তি আর কী! মরার সময় কিচ্ছুতো সাথে যায় না, কাজে আসে না। তবুও আমাদের আগ্রাসী ভোগ আকাঙ্ক্ষা পুরো পৃথিবীর মালিকানা পেলেও তৃপ্ত হওয়ার নয়! বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব সম্পদ চাই, আমার, আমাদের! লোভ-ভোগের তীব্র দৌড়ে বিবেক-মেধা, মনন-শিক্ষা-মানবিকতা সব বুকের খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে। আছে বচন-ভাষণ আর কিতাবে! পারস্পরিক সহমর্মিতা খুঁজতে ছুটতে হবে জাদুঘর! তাইতো ইভিএম মেসিনের নির্বাচনেও প্রার্থীর কর্মী পুরনো অভ্যাসেই মার্কায় সিল মারার স্লোগান দিয়ে মাইকে রাস্তা দাপাচ্ছেন! ওঁদের দোষ নেই-দোষ আমাদের লোভ আর ভোগের ভয়াল আগুন। মনুষ্যত্ব ক্ষয়ের দাবানল থামাবে কে? কোথায় আছেন তিনি!
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক