শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মানুষের মনন পরিশুদ্ধির ঔষধি। সভ্যতার শুরু থেকে এর বর্জন, সংশোধন, পরিমার্জন, পরিশোধন অব্যাহতভাবে চলে আসছে। সাথে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য সাজ সরঞ্জামও। ব্যবহারবিধির বহুমুখী পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলছে সময়স্রোতের সাথে তাল রেখে। বদলেছে মাত্রা, আঙ্গিক ও পরিবেশনা শৈলীও। কিছু কিছু বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন হয়ে কালের বিবর্তনকে ফাঁকি দিয়ে টিকেও গেছে।
নিজে শিল্পবোদ্ধা নই- ভোক্তা মাত্র। তাই মোটাদাগে যেটা বুঝি, মননহীন, শরীরসর্বস্ব মানুষ শিল্প বুঝেইনা। শিল্প মানে বোঝে কল-কারখানা। এটাই বাস্তব এবং নিষ্ঠুর সত্য। আসলে রাজনীতি তথা মধ্যযুগের রাজা বাদশাহ ও জমিদারদের সৌজন্যে শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য ডালপালা মেলেছে। বিকশিত হয়েছে পত্র-পল্লব-পুস্পে। তাই এসব সুকুমার বৃত্তির চর্চা ও বিকাশ প্রায় পুরোটাই রাজনীতি নির্ভর। কিন্তু রাজনীতি যখন মেধাশূন্য, কর্পোরেট ভোগবাদের বাহন হয়ে যায়, তখন শিল্প-সংস্কৃতির বীজতলা শুকিয়ে ধু ধু মরুভূমি হতে বাধ্য। এখন হচ্ছেও তাই। বৈরি পরিবেশে যারা এখনো মননের শুদ্ধতায় শিল্প সাহিত্যের জমিতে ফসল ফলাচ্ছেন, রাজনীতিকদের বোধের রুদ্ধ দ্বার খোলার সাধ্যই তাঁদের নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, তমসার ঘোর আঁধারে ক্রমশ ডুবছিই। মনন-মনীষার সাধকরা অভিমানী হন। কড়ি নয়, আত্মসম্মান এবং আত্মমর্যাদাই তাঁদের মূলধন। মূলধন কখনো তাঁরা ভাঙিয়ে খান না। যারা ভাঙিয়ে খায়,তারা দুর্বৃত্ত, তোষামোদ বানিজ্যের কুশলী বণিক মাত্র। এখন এই বণিকেরাই ভূয়া শিল্প-সংস্কৃতি- সাহিত্য-কৃষ্টির সওদা সাজিয়ে নগদ মুনাফা,পুরস্কার, পদক লুঠছে দুহাতে।
রাজনীতির জাতক এবং কর্পোরেট ভোক্তারা নিজেদের মনন-মনীষা বার বি কিউ বানিয়ে খেয়ে ফেলেছে। হাজারে একজনও শুদ্ধ-পরিশীলিত মননের মানুষ নেই। দেশি-বিদেশি ডিগ্রি, সনদ সবই হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠার সস্তা শো’পিস। সৃজনশীল পেশাগুলোও এখন উপরে উঠার সহজ এলিভেটর। বোধের ভয়ঙ্কর গণ আত্মহনন রুখতে পারে একমাত্র রাজনীতি। কারণ রাজনীতিই একটি দেশ ও জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সাহিত্যকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু রাজনীতি বা সরকারে যারা থাকেন, তাদের ৯৫% যদি কর্পোরেট বাণিজ্য আসক্ত বা বেনিয়া পুঁজির নোকর হয়ে যান, তাহলে কীভাবে? সমকালে অস্বাভাবিক যে সব বর্বরতা সমাজে কোভিড-১৯ থেকেও ভয়ঙ্কর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তার মূল কারণ কিন্তু সুস্থ ও শুদ্ধ সংস্কৃতি-কৃষ্টির গণ আত্মহনন। নিজের অভিজ্ঞতা তাই বলে। নামিদামী ‘ভার্সিটি শিক্ষকের সুশিক্ষা দানের জন্য টানা পাঠ ও গবেষণা জরুরি। পরিপুষ্টির জন্য তাঁকে মাতৃভাষাসহ আন্তর্জাতিক কিছু ভাষায় দক্ষতার পাশাপাশি পরিবেশনাশৈলীতে সর্বোচ্চ উৎকর্ষতাও অর্জন করতে হয়। পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষার বাইরে এটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। একদল বড় পদ ভাগাতে রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে ধনে-মানে ওজনদার হয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। আরেক দল কোচিং বাণিজ্যের আজব রোবট হয়ে যাচ্ছেন। তো, কীভাবে ঘরে ঘরে পরিশুদ্ধ শিল্প, সংস্কৃতি, মননের চর্চা হবে? কারাইবা করবে! এসবের চর্চা ছাড়া মানবিক মানুষ আমরা কোথায় পাব? মানবিক মানুষ ছাড়া অমানবিক বর্বরতার বিরুদ্ধে কোন মুখেইবা প্রতিবাদের নামে নাকে-মুখে গরম ফেনা ঝাড়ছি? প্রশ্নের জবাব নিজকেই খুঁজে নিতে হবে। কোন পন্ডিত বা মিডিয়া বিশেষজ্ঞের কাছে এর সহজ টোটকা চিকিৎসা নেই।
মূল কথা হচ্ছে, রাজনীতিক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, মিডিয়া বা শো’বিজ ব্যাক্তিত্ব, সংস্কৃতিকর্মী অথবা সংগঠক সবাই দ্রুত সেলিব্রিটি হতে চাই। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে নিজেদের ঘরসহ সব ঘরে বিকৃত এবং অসুস্থ সংস্কৃতি ও কঠিন ভোগের অসুখ ছড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় সমাজ, দেশ, জাতি ভুগছে। প্রচন্ডভাবে ভুগছে। শিল্প,সংস্কৃতি ও মনন সুস্থতার জমিনে তবুও কেউ কেউ কঠিন চাষ দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সম্মানজনক স্বীকৃতিও তুলে আনছেন। তাঁরা নিজেদের সাধনা, তৃপ্তি ও শুদ্ধির জন্যই কঠিনকে বুকে তুলে নিয়েছেন, সৃজনের ডিমে টানা ওম দিচ্ছেন। সম্মান দূরে থাক, আমরাতো তাঁদের সুকর্মকে গুনতিতেও নেইনা। এভাবে চললে দ্রুতই সুবোধ ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে যাবেই। রুখার সাধ্য কারো নেই, হবেও না।