ভেবেচিন্তেই আক্রমণ শব্দটি ব্যবহার করলাম। মনুষ্য আক্রমণে পৃথিবী নামক অনিন্দ্য সুন্দর গ্রহটির অস্তিত্ব বহুলাংশেই ঝুঁকিতে পড়েছে। স্টিফেন হকিং মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভবিষ্যৎ বাণী করে বলেছিলেন, মানব সভ্যতার হাতে একশ বছরের বেশি সময় নেই। যে ভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাড়ছে, তাতে করে একবিংশ শতকের মধ্যে ভিনগ্রহে পাড়ী জমাতে না পারলে মনুষ্য প্রজাতিই বিলুপ্তির মুখে পড়বে। হকিং এর কথা, শূন্যে বিলীন হওয়ার আগে, স্পেস এক্সের মালিক এ্যালান মাঙ বললেন, ত্রিশের দশকে মনুষ্যবাহী যান মঙ্গলে পৌঁছবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০১ সালে জন্ম নেয়া এলিসা আরসান হতে চলেছে প্রথম মঙ্গল যাত্রী ২০৩৩ খৃষ্টাব্দে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ১২ বার চন্দ্রে মানুষ পা রেখেছে। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হল, কোন অবস্থাতেই চাঁদে মনুষ্য বসতি স্থাপন সম্ভব নয় এবং বিজ্ঞানীরা ক্যামেরার লেন্স ঘুরালো মঙ্গলের দিকে। মঙ্গল সৌরজগতের ৪র্থ গ্রহ এবং ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক হলেও সমুদ্র বাদে পৃথিবীর ভূ-খন্ডের সমান ভূ-খণ্ড রয়েছে মঙ্গলে। পৃথিবীর মতোই একাধিক ঋতু রয়েছে। বায়ুমন্ডল আছে তবে তা পৃথিবীর মাত্র একশ ভাগের এক ভাগ। ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং মাধ্যাকর্ষণও রয়েছে। তাও পৃথিবীর তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। তাইতো বিজ্ঞানীদের উচ্চাশা হলো, বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর মতো করে সৃষ্টি করা গেলে মঙ্গলে মনুষ্য বসতি গড়া সম্ভব।
রাতের আকাশে মঙ্গলকে খালি চোখে দেখা যায়। কারণ এটি পরিষ্কার লাল একটি গোলক। লাল হবার কারণ সূর্যের তাপে গ্রহটির ভূ-পৃষ্ঠ শুকিয়ে লক্ষ কোটি বছরের ব্যবধানে রুক্ষ লালে পরিণত হয়েছে। শুকিয়েছে যখন তখন নিশ্চিৎ ধরে নেয়া যায়, এক সময় ভেজা ছিল। অর্থাৎ মঙ্গলে পানি ছিল, মেঘ বৃষ্টি ঝড় তুফান সবই ছিল। সমুদ্র ছিল। ৭ মিনিটের বিপজ্জনক সময় পার করে, ১৮ ফেব্রুয়ারী (বাংলাদেশ সময় ১৯ ফেব্রুয়ারী’ ২১ ভোররাত ২.৪৫) জেজোরে ক্রেটার নামক উপত্যকায় নভোযান পারিসিভিয়ারেন্স ল্যান্ড করানোর পেছনে যুক্তি হল, এক সময়কার একটি বিশাল হ্রদ শুকিয়ে আজ রুক্ষ এই নিচু ভূমিখণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গল ডিম্বাকার বৃত্তে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ৬৮৭ দিনে মঙ্গলে এক বছর এবং পৃথিবীর চেয়ে একটু বেশী ২৪ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটে মঙ্গল নিজ কক্ষপথে আবর্তিত বা ১ দিন হয়। মজার বিষয় হলো ডিম্বাকার ঘূর্ণনের কারণে মঙ্গল একসময় পৃথিবীর একেবারে কাছে ৬ কোটি কিঃ মিঃ এবং একপর্যায়ে ৪০ কোটি কিঃ মিঃ সর্বোচ্চ দূরত্বে আবর্তিত হয়। পারসিভিয়ােেরন্স ৩০ জুলাই ২০২০ উৎক্ষেপণ করার কারণ ছিল, প্রায় ৭ মাস চলার পর ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখের দিকে দূরত্ব নেমে এসেছিল ৬ কোটি কিঃ মিঃ এর কাছাকাছি।
সম্প্রতি ৩টি নভোযান পাঠিয়ে মানুষ মঙ্গলকে রীতিমত ঘিরে ধরতে চলেছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি নাসা পারসিভিয়ারেন্স নামালো। চীন নভেম্বর ’২০ এ তিয়ান ওয়ান- ১ নামের যে নভোযানটি পাঠিয়েছে, সেটি ল্যান্ড করবে ২ মে’ ২১, তৃতীয় অভিযাত্রী দেশ কুয়েত পাঠিয়েছে ৯ ফেব্রুয়ারী’ ২১ হোপ প্রোব নামের নভোযান। সেটি অবশ্য মঙ্গল পৃষ্ঠে ল্যান্ড না করে শুধু কক্ষপথে চক্কর লাগাবে জুলাই’ ২১ এর শেষদিকে। সবার লক্ষ্য একটাই, মঙ্গলের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন। এক সময় কি মঙ্গলে প্রাণ ছিল অথবা যে কোন ফর্মে এখনো কি প্রাণের অস্তিত্ব আছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর রকি পাহাড়ের পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে নানারূপ ছোট উদ্ভিদ সহ অনুজীব পাওয়া যাবে। মঙ্গলের রুক্ষ পাথর খণ্ডগুলোর ফাঁকেও তো অমন ক্ষুদ্র জীব, অনুজীব, উদ্ভিৎ থাকলে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই।
১৯৬৫ থেকে আজ পর্যন্ত ৫২ বার নভোযান আক্রমণ রচনা করেছে মঙ্গলকে লক্ষ্য করে। এর মধ্যে মাত্র ২০ টি সফল গণ্য করা যায়। অর্থাৎ ৩২টি মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এগুলো মঙ্গলের কক্ষপথে গিয়ে হয় অকার্যকর হয়েছে অথবা বিধ্বস্ত হয়েছে অথবা অজ্ঞাত কারণে পৃথিবীর কন্ট্রোল রুমের সাথে সংযোগ হারিয়েছে। একবার হাারিয়ে গেলে ঐ নভোযানের সাথে পুনর্বার সংযোগ স্থাপন সম্ভব না হবার মূল কারণ দূরত্ব। পারসিভিয়ারেন্স এখন অনবরত যে সিগনাল পাঠাচ্ছে তা মাদ্রিদের রিসিভারে পৌঁছে প্রায় ১১মিনিট পর। দূরত্ব যত বাড়বে সিগনাল পাওয়ার সময় ততই বাড়বে। মঙ্গল যানের মধ্যে মেরিনার ফোর, মেরিনার নাইন, গ্লোবাল সার্ভেয়ার, মার্চ এক্সপ্রেস, বিগাল-২, এঙপ্লোরেসন, মাবেন, কিউরিসিটি, ইনসাইট অন্যতম।
পারসিভিয়ারেন্সের পেটের মধ্যে লুকিয়ে আছে ব্যাঙ্গালুরুর জে বব বলরামের বেইন চাইল্ড হেলিকপ্টার। দু’মাস পর এটি রোডারের পেট থেকে বেরিয়ে উড়ে নামবে একশ মিটার দূরে। যেখান থেকে ছবি পাঠাবে পৃথিবীতে। ইনজিনিউটি নামের হেলিকপ্টারটি ৫ বার উড়াল দিয়ে ৫ জায়গা থেকে ছবি পাঠাবে, তথ্য পাঠাবে। এবারের অভিযানের সবচে’ বড় বৈজ্ঞানিক সাফল্য হবে যদি মাঙ নামের ডিভাইসটি সত্যি সত্যি চাঁদের বায়ু থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে বোতলজাত করতে সক্ষম হয়।
পারসিভিয়ারেন্সের রোভার আশপাশ থেকে নুরি বালি, ছোট বড় প্রস্তর খণ্ড, পাথর ও মাটি সংগ্রহ করে এক জায়গায় স্তূপাকারে জমা করবে। আজ পর্যন্ত পাঠানো সব নভোযানই ছিল একমুখী। এগুলোর কোনটিই পৃথিবীতে ফেরৎ আসবে না। নাসা পরিকল্পনা করেছে, পরবর্তীতে পাঠানো নভোযান মঙ্গলপৃষ্ঠে নেমে জমিয়ে রাখা মাটি, বালি, পাথর নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। যেতে পারলে ফিরে আসা যাবে- এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। চিফ কন্ট্রোলার ব্যাঙ্গালুরু কন্যা শ্রুতিমোহন ফ্লোরিডায় বসে তেমন স্বপ্নই দেখেন।
আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য সাক্ষ্য দেয়, মঙ্গলের মেরু অঞ্চলে অফুরন্ত জল বরফ আকারে স্তূপীকৃত হয়ে আছে মাটির নীচে অথচ বাতাসে নেই আর্দ্রতা। জলাশয় নেই। তাপমাত্রা রাতের বেলা ৫০ ডিগ্রীর নীচে নেমে যায়। এই বৈরী আবহাওয়াকে কিভাবে মনুষ্য উপযোগী করা যায় তা এক কঠিন বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ। একদল বিজ্ঞানী বলছেন, পৃথিবীর মতো ওজনস্তর না থাকায় অতিবেগুনী রশ্মির কারণে মানুষ মঙ্গলে বেশীক্ষণ টিকতে পারবে না। সমাধান হিসেবে এরা পৃথিবীর মতো গ্রীন হাউস সৃষ্টির কথা বলছেন। মঙ্গল পৃষ্ঠে যদি গ্রীন হাউজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় তবে বাষ্প- মেঘ-বৃষ্টি-ওজনস্তর সবই সম্ভব।
আরেকদল বিজ্ঞানীতো আরেক কাঠি সরস। তাঁদের ফর্মুলার নাম টেরাফাইয়িং। এর অর্থ হলো মঙ্গল পৃষ্ঠে যদি আণবিক বোমা ফেলা যায় তবে যে ধুলো, ধোঁয়া, রেডিয়েশন সৃষ্টি হবে- তা থেকে মেঘ-বৃষ্টি-ওজনস্তর সৃষ্টি হতে বাধ্য। একবার এই প্রক্রিয়া সৃষ্টি করা গেলে দূর-ভবিষ্যতে মঙ্গলও আরেকটি পৃথিবী হবে মানুষের পদভারে চঞ্চল, চকিত।
এ জন্য বলছিলাম, মানুষ মঙ্গলে আক্রমণ শানাচ্ছে। প্রকৃতি ধ্বংস করার কাজে যে আমরা ওস্তাদ তার প্রমাণ এখন হাতে হাতে। টেরাফাইয়িং এর বোমা ফেলার চিন্তা যাদের মাথায় আসে তাদের আক্রমণকারী বলাই শ্রেয়। ভয় হয় ওরা কখন মঙ্গল গ্রহটার বর্তমান চেহারাটাই না পাল্টিয়ে ফেলে। এরপরও আশা রাখতে হবে বিজ্ঞানের উপর প্রযুক্তির উপর। ভিনগ্রহে আমাদের পাড়ি দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
রাতের ঘুমকে উপেক্ষা করে মঙ্গল পৃষ্ঠে পারসিভিয়ারেন্সের অনিন্দ্য সুন্দর অবতরণ দৃশ্যটা দেখছিলাম। ১১ কিঃ মিঃ ব্যবধানে দৈত্যকার প্যারাসুট বেলুনটি খুলে গেল, আস্তে আস্তে ঘণ্টায় ২০,১০০ কি: মি: গতি কমতে শুরু করল, এক সময় ল্যান্ডার স্পর্শ করল মঙ্গল পৃষ্ঠ। এই প্যারাসুট বেলুনের কারিগর হলেন নাসায় কর্মরত বাঙালী সন্তান খাগড়ার অনুভব দত্ত ও বর্ধমানের সৌম্যদত্ত। জয় হোক বিজ্ঞানের, জয় হোক প্রযুক্তির। লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট