“পথিক, ক্ষণিকের তরে বস মোর শিরে,/ ফাতেহা পড়িয়া যাও, নিজ নিজ ঘরে।/ যে সব আসিবে মোর সমাধির পাশে,/ ফাতেহা পড়ে যাবে। মম মুক্তির আশে।/ অধম মনিরুজ্জামান নাম আমার; ইসলামাবাদী বলে সর্বত্র প্রচার।” অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের নির্লোভ-নির্মোহ-ত্যাগের মহিমায় পরিশুদ্ধ মওলানা ইসলামাবাদী কী অলোকসুন্দর আবাহনে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন- তা সহজে অনুমেয়। কর্ষিত বিনয়ী আবেগ-কাতরতা-অসহায়ত্ব; মেধা ও প্রজ্ঞার সহজ-সরল কাব্যগাথায় পৃথিবী নামক এই গ্রহ থেকে মহাপ্রয়াণের পূর্বে অন্তরের গভীর ইচ্ছা নিবেদন করে গেছেন। ভারতবর্ষের দুই মহান বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অগ্রগণ্য অভিভাবক ও প্রক্ষোভ বিবেকখ্যাত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক আবুল ফজল ‘মওলানা ইসলামাবাদী’ শিরোনামে তাঁদের অমূল্য লেখনিতে এই মহান কৃতীমানবের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
১৮৭৫ সাল ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলা; বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলা বরমা ইউনিয়ন আড়ালিয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। কালের যাত্রায় সার্থক উজ্জীবন পরিচয়ে মহান সাধক ও চিন্তক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বকীয় ঋদ্ধ বলয়ে হয়েছেন নিষিক্ত উদ্ভাসিত। বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভিধায় অভিষিক্ত এই চট্টল মনীষা অনুগ্র চিন্তা-চেতনা-ভাবনার প্রকীর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনন্য মর্যাদায় সমাসীন হয়েছেন। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর লেখনিতে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯১০ সালে মওলানা সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ প্রথম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তাঁদের পরিচিতির গাঢ়ত্ব পরিণতরূপ ধারণ করে ১৯২১ সাল ৪ সেপ্টেম্বর। এ সময়ে মওলানা ইসলামাবাদী ও অন্যান্য সাহিত্যিকদের সম্মিলিত চেষ্টায় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে যার প্রথম সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতানুসারে তিনিসহ মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখের সাথে ১৯১৩ সালে মওলানা ইসলামাবাদী ‘আঞ্জুমান-এ-ওলামা-এ বাঙ্গালা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমিতির মুখপাত্র ‘আল-এসলাম’ এ মওলানা ইসলামাবাদী এবং ড. শহীদুল্লাহ বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ড. শহীদুল্লাহ’র তীক্ষ্ণ বিবেচনায় তাঁরা উভয়েই ছিলেন যুক্তিবাদী ইসলামে বিশ্বাসী। ১৯১৪ সালে ড. শহীদুল্লাহ বি.এ পাস করে মওলানা ইসলামাবাদীর পরামর্শ ক্রমে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগদান এবং সেখান থেকেই ১৯১৫ সালে বসিরহাটে ওকালতি আরম্ভ করেন। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে আঞ্জুমান-এ-ওলামা-এ বাঙালা’র দ্বিতীয় সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ইসলামাবাদী।
ড. শহীদুল্লাহ’র ভাষায়, ‘মওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন একজন আলেম কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী-জ্ঞান-বিজ্ঞানের পক্ষপাতি, সমাজ সেবক ও সমাজের কর্মী। নানা অর্থকষ্টের মধ্যেও তিনি সাহিত্য সাধনা ও সমাজ সেবা করে গিয়েছেন। তাঁর শেষ কার্য ছিল চট্টগ্রামে একটি এতিমখানা স্থাপন, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এবং স্থাপনার জন্য চট্টগ্রামের নিকটবর্তী দেয়াংপাহাড়ে বিস্তৃত জমিও সংগ্রহ করেছিলেন। বর্তমান সময়ে তাঁর অভাব আমরা বিশেষ ভাবে অনুভব করি। আল্লাহ্তালা তাঁর রুহের মাগফেরাত করুন – এই প্রার্থনা আমরা সকলে সমবেতভাবে করি।’ আমাদের সকলেরই জানা যে, ব্রিটিশ ভারতের প্রায় সকল প্রদেশই স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিকশিত। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্ম-শিক্ষা, অনগ্রসর-প্রাগ্রসর অঞ্চল হিসেবে বহুধা সত্তায় খণ্ডিত ও বিভাজ্য। জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম অধ্যুষিত বর্তমান বাংলাদেশ ছিল ভাষা-সংস্কৃতি-জীবনপ্রবাহ ও কর্ম-শিক্ষায় বহুলাংশে সমৃদ্ধ।
অধ্যাপক আবুল ফজল’র মতে “১৮৫৭’র বিপর্যয়ের সেই যুগসন্ধিক্ষণে মাওলানা মনিরুজ্জামানদের আবির্ভাব। তখন বাঙালি মুসলমান সমাজে মোটামুটি দুই শ্রেণীর নেতৃত্ব দেখা গিয়েছিল। এ দুই নেতৃত্বও সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজনেরই ফল। দুই নেতৃত্বেরই উদ্দেশ্য একই ছিল যদিও পথ ছিল ভিন্নতর। উভয় নেতৃত্বেরই আদর্শ ছিল সমাজকে আত্মসচেতন করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দেওয়া। যুগের মোকাবেলার পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র সমাজ হিসেবে মুসলমানকে আত্ম প্রতিষ্ঠার সহায়তা করা।” প্রকৃতপক্ষে একটি ধারা ছিল ইংরেজি শিক্ষায় তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে দেশের শাসন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালন। ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে সমাজ-মননে মুসলমানদের অবদানকে অগ্রগণ্য করার প্রচেষ্টা একেবারেই যে ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না। এই প্রক্রিয়ায় কলিকাতার আলীয়ার মতো উচ্চমার্গের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং এর সাথে এ্যাংলো এশিয়ান বিভাগ সংযোজন উল্লেখযোগ্য।
অন্য ধারায় পরিপূর্ণ সরকার বিরোধী মনোভাব পোষণ এবং যৌথ উদ্যোগে সীমিত নিজস্ব সম্পদের বিনিময়ে মহান আল্লাহ্তায়ালার অপার রহমত-নির্ভর আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় ছিল মৌলিক অবলম্বন। আপামর জনসাধারণের মঙ্গল সাধন এবং ধর্ম-জাতীয়তাবোধে জাগ্রত নেতৃত্বের অধিকাংশই ছিলেন আলেম সমাজ। ধর্মভিত্তিক চিন্তা-চেতনায় এঁদের কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হলেও সম্যক উপলব্ধিতে ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যম ছাড়া বাংলাদেশে কোন উদ্যোগই সফল হতে পারে না। এটিই ছিল ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ দর্শনের অবিস্মরণীয় চিন্তন। কাল পরিক্রমায় মওলানা ইসলামাবাদী এই ধারারই অন্যতম পথপ্রদর্শক এবং ধারক ও বাহক। সমগ্র জনগোষ্ঠীর কার্যকর কল্যাণ সাধন-জাতির উন্নয়ন-জীবনযাত্রার সমস্যা সমাধানে প্রায়োগিক পন্থার স্বরূপ উন্মোচনই ছিল এঁদের প্রণিধানযোগ্য উদ্দেশ্য। মওলানা ইসলামাবাদী সম্ভবত তাঁর পরমশ্রদ্ধেয় পিতা মুনশী মতিউল্লাহ’র কাছ থেকে বাংলা শিক্ষার পাঠ গ্রহণ এবং পরবর্তী পর্যায়ে নিজ প্রচেষ্টায় এর অনন্য উচ্চতায় সমৃদ্ধকরণে অসামান্য প্রজ্ঞা-মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ্য যে, তাঁর সৃজনশীল কর্ম প্রণোদনায় তিনি বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ-প্রবন্ধ-প্রকাশনা রচিত করে মুসলমান সম্প্রদায়কে জ্ঞানাঙ্কুর উদ্দীপনায় প্রজ্বলন করতে পেরেছিলেন। এসব সর্বজন সমাদৃত লেখনির মধ্যে ছিল- কোরআনের স্বাধীনতার বাণী, তুরস্কের রাজধানী মহানগরী কনস্টান্টিনোপলের বিশেষ বিবরণ, ভারতের মুসলমান সভ্যতা, ভারতে ইসলাম প্রচার, সমাজ সংস্কার, তুরস্কের সুলতান জীবনী, খাজা নেজামুদ্দীন আউলিয়া, মুসলমানদের সুদ সমস্যা ও অর্থনীতির মৌলিক সমাধান, নুশিক্ষা ও শিক্ষাকর, খগোল শাস্ত্রে মুসলমান, ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান, আওরঙ্গজেব, মোসলেম বীরাঙ্গনা, ইসলামের শিক্ষা, হযরতের জীবনী, রোজনামচা, পৌরাণিক ও বৈদিক যুগ, ইসলাম ও রাজনীতি, তাপসকাহিনী, শিল্পক্ষেত্রে মুসলমান, রাজনীতির ক্ষেত্রে আলেম সমাজের দান, শুভ সমাচার, স্পেনের ইতিহাস, বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের জাতীয় উন্নতির উপায়, আত্মজীবনী পরিশিষ্ট, একটি ইংরেজি ও উর্দু বাংলা প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য।
মওলানা ইসলামাবাদী শিক্ষা জীবন শেষে সরকারি চাকরির মোহ পরিত্যাগ করে ১৮৯৬-৯৭ সালে রংপুর শহরের মুনশীপাড়া জুনিয়র মাদ্ররাসায় হেড মৌলভী পদে যোগদান এবং পরবর্তীতে ১৯০০ সালে ছয় মাস চট্টগ্রামের মৌলভী আবদুল আজিজ প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বোড়িংয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদে কাজ করেন। তিনি সীতাকুণ্ড সিনিয়র মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক পদেও কর্মরত ছিলেন। সত্য-সুন্দর ও মঙ্গল সন্ধানে কুসংস্কার বিহীন সত্যনিষ্ঠ মানুষ গড়ার লালিত স্বপ্নে তাঁর জীবন ছিল ব্যাপৃত। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জাতীয় নেতার মতো অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। অসহযোগ-বঙ্গভঙ্গ রদ-খিলাফত আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। মওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন ১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ এর অন্যতম স্থপতি। বিশ শতকের ত্রিশ দশকে কংগ্রেস ছেড়ে কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগদান এবং দলের মনোনয়নে ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রামের সদর দক্ষিণ মহকুমা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি চট্টগ্রাম টাউন ব্যাংকেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
সাহিত্য-সাংবাদিকতা-সমাজসেবা-সমাজ সংস্কার ইত্যাদি যুগান্তকারী কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে তিনি মুসলিম সমাজের অপরিসীম দু:খ-দুর্দশা লাঘবে এবং নানামুখী অধ:পতন থেকে এদের সুরক্ষা কর্মকৌশল ও প্রেরণার মার্গশীর্ষ দৃষ্টান্ত হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯২৮ সালে দৈনিক ‘আম্বর’ পত্রিকা প্রকাশ, ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে ইয়াতীমখানা প্রতিষ্ঠা এবং ‘ইসলামাবাদ’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনা তাঁর নান্দনিক-মননশীল কৃতী। মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও নিখাদ দেশপ্রেমে অত্যুজ্জ্বল চিন্তক ও সাধক মওলানা ইসলামাবাদী প্রায় ৭০ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে কারাবন্দী ছিলেন।
সে সময় জেলে-বসে নিভৃত কক্ষে রচনা করেছেন অভিমানী পদ্য- ‘ষাটের উপরে আরো দশ বছর বৃথায় কেটেছে জীবন আমার/ দেশে-দেশান্তরে ভ্রমি সমাজ সেবায় রাজনীতি, সমাজনীতি সাহিত্য চর্চায়।/ ধর্ম প্রচারের কাজে, বিস্তারে শিক্ষায়, এসব কাজেতে মোর কেটেছে সময়।/ কিন্তু হায়! জন্মস্থান নিজ বাসভূমে সাধু কার্য করি নাই, নিজ পল্লীধামে,/ সংকল্প করিয়াছি জীবন সন্ধ্যায় জীবনের অবসান করিব এথায়।’ অভূতপূর্ব গৌরব-অর্জনে মহিমান্বিত চট্টল মানস মওলানা ইসলামাবাদী ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর ৭৫ বছর বয়সে চিরতরে না ফেরার দেশে গমন করেন। অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী স্বপ্রতিষ্ঠিত ইয়াতীমখানা সংলগ্ন কদম মোবারক মসজিদের সম্মুখে প্রাচীন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মহাপ্রয়াণের আজকের এই দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মহান স্রষ্টার দরবারে তাঁর আত্মার প্রগাঢ় শান্তি প্রার্থনা করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়