(পর্ব–১)
পূর্বের সবগুলো ক্রস কান্ট্রি রাইডেই সঙ্গী হিসেবে কেউ না কেউ ছিল। এবার আর সঙ্গীর খোঁজ করিনি। একাই একটা ক্রস কান্ট্রি রাইড দেওয়ার ইচ্ছা। সুবিধাজনক একটা সময়ও বেছে রেখেছিলাম। গুলিস্তানে গিয়ে সাতক্ষীরাগামী কোনো একটা বাসে উঠে যাওয়ার পরিকল্পনা। যন্ত্রচালিত বাসে প্যাডেলচালিত সাইকেল কেউ নিতে চাইল না। ইমাদ পরিবহনের সুপারভাইজরের সাথে জোঁকের মতো লেগে রইলাম। আর সে আমার মুখে ক্রমাগত নুন ঢালতে থাকল! তার কর্কশ ধ্বনির ন্যায় কথাবার্তা তথা নুনের তোড়ে আমার জোঁকসত্তা খানিক বাদেই লোপ পেয়ে গেল। আরো দুইটা বাসের কন্ডাক্টরকেও রাজি করাতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষমেশ চলে গেলাম সায়েদাবাদে। প্রথম সারির পরিবহনগুলো বাদ দিয়ে দ্বিতীয় সারির পরিবহনগুলোকে পাখির চোখ করলাম। ব্যাপারটা কাজে দিল। ইগল পরিবহনের বাস ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিল। বাক্সে সাইকেলের জায়গা হবে বললেও দেখা গেল অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ দৈর্ঘ্যের বাক্সে আমার সাধের দুই চাকার স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কন্ডাক্টর কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞেস করল সাইকেল নিয়ে আমি পেছনের সিটে বসতে পারব কি না। প্রস্তাব শুনে আমি খুশিতে ডগমগ। বাক্সে সাইকেল দেওয়া মানেই ফ্রেমে দাগ পড়া অবশ্যম্ভাবী। সেই হিসেবে সাইকেল নিয়ে বাসের পেছনের সিটে বসা অতি উত্তম প্রস্তাব। মুখে খানিকটা কৃত্রিম বিরক্তি নিয়ে আর বাকি যাত্রীদের ‘সরি’ বলতে বলতে বাসের পেছনের সিটে সাইকেল নিয়ে গেড়ে বসলাম।
বাস যখন সাতক্ষীরা বাস স্ট্যান্ডের কদমতলায় নামিয়ে দিয়ে গেল, তখনো আকাশে একটা–দুটো তারা নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। খানিক বাদেই অবশ্য মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে গেল তারাদের। প্যাডেল ঘুরানো শুরু করতেই চোখে পড়তে থাকল একটা শহরের নানান উপাদান– সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখানে–ওখানে ছড়িয়ে। ইটাগাছা পার হয়ে বিজিবি চেকপোস্টের কাছে আসতেই রাস্তা সাপের জিভের মতো দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা এগিয়েছে কালীগঞ্জের দিকে, অন্য রাস্তাটা আমার আপাত লক্ষ্য ভোমরা স্থল বন্দরের পানে এগিয়েছে। রাস্তার দুপাশে মেহগনি গাছের আধিপত্য। আলিপুর পার হয়ে মাহমুদপুর। এদিকের সব দোকানই আগাগোড়া গ্রিল দ্বারা সুরক্ষিত। এত সুরক্ষা কীসের জন্য কে জানে! রাস্তার দুপাশে সার বেঁধে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় বুঝতে পারলাম স্থল বন্দর সামনেই। ভারতীয় ট্রাকও দাঁড়িয়ে আছে প্রবেশের অপেক্ষায়। ভোমরার শেষ ৩ কিমি রাস্তা অসম্ভব ভাঙা। রাস্তার গর্তগুলো অনেক কুয়াকেও হার মানাবে। তার উপর যুক্ত হয়েছে ঝুম বৃষ্টি। সাইকেল আরোহীকে বেকায়দায় ফেলার সকল আয়োজন সম্পন্ন। কাদা পেরিয়ে সীমান্ত দেখে এসে সাইকেল ঘোরালাম। সাতক্ষীরা পর্যন্ত পথটুকুতে পুনরাবৃত্তি। সাতক্ষীরা মেডিকেলের সামনে থেকে বাইপাস সড়ক না ধরে শহরের ভেতরের রাস্তাটাই ধরলাম। শহর ছাড়িয়ে শহিদ কাজল সরণির দিকে এগোচ্ছি। উদ্দেশ্যে আদি ফকির মিষ্টান্ন ভান্ডার বা জায়হুণের সরপুরিয়া খাওয়া। এদের সরপুরিয়ার বেশ নামডাক। সরপুরিয়ার জন্য বিখ্যাত ওপার বাংলার কৃষ্ণনগর। এদিকের সরপুরিয়ার খ্যাতি শুনতে পেয়েছি সম্প্রতি। কিন্তু বিধি বাম। এত সকালে দোকান বন্ধ হওয়াতে মিষ্টি মিলল না। চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিয়ে সে দুঃখ ভুললাম।
ডানে মোড় নিয়ে এবার তালতলার পানে এগিয়ে চলা। এই রাস্তাই ক্রমশ খুলনার দিকে নিয়ে যাবে আমাকে। ঋশিল্পী নামে সুন্দর একটা স্কুল পেরিয়ে পড়ল বেতনা তথা বেত্রাবতী নদী। ছোট্ট, শীর্ণ নদী। শুকনো রোগীর মতো চেহারা এই স্রোতঃস্বিনীর। এর পাড়েই বিনেরপোতা বাজার। বৃষ্টির জোর ততক্ষণে বেড়েছে আরো। না–উঠা সূর্যটা এত ফ্যাসাদে ফেলবে কে জানত! এদিকে প্রচুর টালির ছাদের তৈরি ঘর। রাস্তার দুপাশে বড় কোন গাছ নেই। ছায়া নয়, বৃষ্টির ছাঁট থেকে অল্প মুক্তিতেই গাছ নিয়ে মূল আগ্রহ। রাস্তার দুপাশে সদ্য কৃষ্ণচূড়া লাগানো হয়েছে। এরা ছায়া কিংবা ছাওয়া দেওয়ার উপযোগী হতে সময় লাগবে আরো বহুদিন। অবশ্য ঝড়–হাওয়া সামলাতে কিঞ্চিৎ অপারগ কৃষ্ণচূড়া ততদিন টিকে থাকলে হয়। তার উপর গাছপালার উপরে কাঠলোভীদের আক্রোশ তো আছেই। কে জানে এই পথের সৌভাগ্য হবে কি না কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা দেখার! বাইগুনী মোড় পার হয়ে বলফিল্ড মোড়। খুব সম্ভবত নামটা ফুটবল খেলার মাঠের সাথে সম্পর্কিত। আমার মা এই টাইপ নাম উচ্চারণ করে। বলফিল্ড মোড়েই রাস্তার ধারে নৌকা বানানো হচ্ছে। নৌকা নির্মাণের কাজটা সমুদ্র কিংবা নদীতটেই দেখে অভ্যস্ত আমার দুই চোখ। এরকম রাস্তার ধারে নৌকা তৈরি করতে আগে দেখিনি। অবশ্য কপোতাক্ষ নদ এখান থেকে অনেক বেশি দূরেও নয়।
এইসবে চোখ রাখতে রাখতে পাটকেলঘাটায়। পাটকেলঘাটায় প্রবেশ করে কাউকে ইট না মারায় ফিরতি পাটকেল খেতে হলো না! এই বাজার বিখ্যাত অনেকগুলো মিষ্টির দোকানের জন্য। সাতক্ষীরার আদি ঘোষ কিংবা যাদব ঘোষের ছড়াছড়ি বাজারজুড়ে। এসব জায়গায় পথচলতি এসে পড়লে পরোটা দিয়ে শখানেক গ্রাম ছানা খেতে ছাড়ি না। আজও তার ব্যত্যয় হলো না। দাঁতের উপর ন্যূনতম খাটাখাটি না করে খাওয়া যায়, এমন মিষ্টান্ন দুনিয়াতেই বিরল। হাতের কাছে পাওয়া এমন সুস্বাদু মিষ্টি হাতছাড়া করা একেবারেই উচিত নয়। বৃষ্টি ততক্ষণে আরো শক্তি সঞ্চয় করে তেড়েফুঁড়ে নামছে। পাটকেলঘাটায় কপোতাক্ষের নদের উপর নির্মিত সেতু পেরিয়েই কুমিরা। খানিক বাদেই নওয়াপাড়া ছাড়িয়ে মদনপুর বাজার। পরের বাজারের নাম সুভাষিণী বাজার। মধুরভাষী কাউকে না পাওয়াতে এখানেই বিদায় জানালাম সাতক্ষীরার তালা উপজেলাকে। কোন চাবির সাহায্য না নিয়েই তালা পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায়। পরবর্তী জনপদ আঠারো মাইল বাজার। এখান থেকেই ডানের রাস্তা দিয়ে পাইকগাছা হয়ে যাওয়া যায় খুলনার অন্যতম দুর্গম উপজেলা কয়রায়। রাস্তায় প্রচুর পিপিই গাউনকে রেইনকোট হিসেবে ব্যবহার করা লোক ভ্যান/মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছে। কে জানে কোভিডের প্রণোদনা হিসেবে পেয়েছে কি না! কালো রেইনকোটে পেঙ্গুইনের আকৃতি ধারণ করে হেঁটে যাচ্ছে দুই শিশু।
পরের বাজার চুকনগর। এটি বিখ্যাত দুই কারণে। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত সবচেয়ে বড় একক গণহত্যা ঘটে এই চুকনগরেই। অন্য বিখ্যাত বস্তু হলো আব্বাসের হোটেলের চুই ঝালের মাংস। দুই দ্রষ্টব্যের সাথেই একাধিকবার পরিচয় থাকায় এখানে আর থামলাম না। খর্নিয়া বাজারে পেলাম হরি নদী। পার হয়ে ডুমুরিয়া বাজার। এ–অঞ্চলে প্রচুর সবজি হয়। পুঁইশাক, লালশাক ভর্তি ভ্যান অহরহ চোখে পড়ছে। মাল্টা বোঝাই এক টমটমের সুবাস নিতে নিতে অনেক দূর গেলাম। গুটুদিয়া ছাড়িয়ে কৈয়া বাজারের কাছে পেলাম শোলমারী নদী। আরো খানিকক্ষণ প্যাডেল চালিয়ে জিরো পয়েন্টে। খানিক বাদেই খুলনার রাবাত ভাই মোটরসাইকেলে চলে এলেন। কামরুলের হোটেলে চুই ঝাল দিয়ে গরুর মাংস খেয়ে রূপসা সেতুর দিকে এগোলাম।