ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৮ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

সময়ের কথন : ভগ্নহৃদয় ও বার্মা

রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে ঢোকা শুরু করে তখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। মিনিটে মিনিটে টিভি’র পর্দায় দেখা যেত হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দোলনা কাঁধে নিয়ে বৃদ্ধ মাবাবাদাদীকে কাঁধে বয়ে নাফ নদী পার হয়ে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার দৃশ্য যারা দেখেছে তাদের জন্য এটা সারা জীবনের দুঃসহ স্মৃতি হয়ে আছে।

আমি আমার আবাসিক এলাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তখন দেখেছি কিছু খেয়ে বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর পার্থক্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বার্মা থেকে বাঙালি খেদাও এর সময় যাতায়াতবিহীন, খাদ্যবিহীন সর্বহারা মানুষের অন্তবিহীন পদযাত্রা একবার কল্পনা করি আমরা। এই অনন্ত পদযাত্রার কাহিনীও শুনেছি আমি অসংখ্য ভুক্তভোগীর মুখে। পারিবারিকভাবে আমাদের বাড়ির যৌথ পরিবারের সবাই একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রামের প্রতি এলাকায় অভাবের আহাজারি। এই প্রেক্ষাপটকে আরো দুঃসহ করেছিল ৪৩ এর দুর্ভিক্ষ।

মান্দালয় (বার্মার ২য় বৃহত্তম শহর) অনেক উন্নত অঞ্চল, এখানে হাজার বছর পুরোনো রাজত্ব (Dynasty) ছিল। এরা ৬০ বছর বৃটিশদের সাথে যুদ্ধ করে। এই রাজবংশের তিনজন প্রভাবশালী রাজা বাইল্লাউং, আনাওয়ারথা, আলাউন পারাতাদের জৌলুষময় জীবনের জন্য বাঙালীরা তাদেরকে ‘হাওয়া রাজা’ বলত, বাঙালি বুড়াবুড়িরা মান্দালয়কে ‘হাওয়ারবাজার’ রাজধানী বলত। বাঙালি খেদাও আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা ঘোষণা দিয়েছিল যে একজন বাঙালি নিহত করলে ১ টাকা পাবে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি বার্মিজ নেতৃত্ব ঘোষণা দেয় যে একজন বার্মিজ নিহত করলে দুই টাকা দেওয়া হবে। এভাবে ৪০ থেকে ৪৪ পর্যন্ত গোটা বার্মায় বাঙালিবার্মিজ দাঙ্গা অব্যাহত থাকে। তার জেরে বাঙালিরা বার্মা ছাড়তে থাকে। তাদের ব্যবসা বাণিজ্য, দোকানপাট, বাড়িঘর সব লুট করে বার্মিজরা। বৃটিশরা সর্বশেষ বার্মিজ রাজা থিবাউকে ভারতের রত্নাগিরি দুর্গে আমৃত্যু বন্দী রাখে। ১৮৮৫ সালে তাকে চূড়ান্ত পরাজয় করে বৃটিশরা রাজাকে ভারতে নির্বাসন দেয়। তিনি ১৯১৬ সালে ভারতেই মৃত্যুবরণ করেন। তার মেয়ে ভারতেই রয়ে যান। একইভাবে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সমাপ্তি হলে শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দী করে। তারা অত্যন্ত নির্দয়ভাবে (Unceremonious) বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনের এক জঙ্গলে নির্বাসন দেয়। তারা অপমান করার জন্য সম্রাট বাহাদুর শাহ ও বেগম জিন্নাত মহলকে গরু গাড়িতে করে দিল্লীর রাস্তা দিয়ে প্রদক্ষিণ করায়, ৮৭ বছর বয়সে ১৮৬২ সালে রেঙ্গুনে তিনি মারা যান। তাকে গোপনে কবর দেয়া হয়। কবিতা লেখার জন্য তাকে কাগজকলম দেয়া হত না। পুরো বন্দী জীবনে মাটির ঘরের দেয়ালে অনেক ‘শের’ (কবিতা) লিখেন। সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাও মাটির দেয়ালে লিখিত।

কত বদনসীব তুমি জাফর

দাফনের জন্য স্বদেশের মাটিতে

দু’গজ জায়গা মিলল না।

প্রয়াত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীবগান্ধী এই কবিতার নীচে লিখেছিলেনবদনসীব তুমি নও! কোটি ভারতীয়ের হৃদয়ে তোমার স্থান। বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর বিশ বছর পর তার স্ত্রী জিনাত মহল ও তার দুই বৎসর পর পুত্র জওয়ান বক্স মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসের সমাপ্তি এখানেই ঘটতে পারত।

কিন্তু হয়ত স্রষ্টা এই ঘটনাকে অমর করতে চেয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে একদল ভারতীয় এই কবর দেখতে এলে এখানে কোন চিহ্ন দেয়ার দাবি করেন। কিন্তু বৃটিশ সরকার তা অগ্রাহ্য করে। ১৯০৫ সালে রেঙ্গুনের মুসলিমরা এক বিরাট বিক্ষোভ করলে ১৯০৫ সালে কবরের নির্দেশক একটি সাইনবোর্ড বসানো হয়। কিন্তু তাতেও হয়তো স্রষ্টা খুশি হতে পারেন নি। ১৯৯১ সালে রেঙ্গুন মিউনিসিপ্যালটির পাইপ খোড়ার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা কিছু কংকাল পায় যা পরীক্ষানিরীক্ষায় সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বলে প্রমাণিত হয। ১৯৯৫ সালেই রেঙ্গুনের মুসলিমরা সেখানে এক বিশাল সমাধি সৌধ মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে পার্কিং মেহমানখানাসহ এটা একটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় এবং একটা দৃষ্টিনন্দন ট্যুরিস্ট সাইট। এই কমপ্লেক্সে ২০১৬ সালে আমার জুমার নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়েছিল। জুমার দিন একজন রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইংরেজিতে ও বর্মা ভাষায় বয়ান করলেন। একজন আরবী খুতবা পড়লেন। ৩য়জন নামাজ পড়ালেন। এটাও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নামাযের শেষে দেখলাম প্রত্যেকে ওয়ানটাইম প্লেট নিয়ে লাঞ্চ করতে বসে গেল। প্রতি জুমায় প্রায় পাঁচশ মানুষকে খাবার দেয়া হয়।

রেঙ্গুন থেকে পালানোর পর অনেক মানুষ আবারো ফেরত গিয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। মূলত সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে রেঙ্গুনের তুলনায় কর্মসংস্থানের অভাবেই এসব মানুষ সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে বার্মা ফেরত যায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বার্মার বৃটিশ গভর্নরের অফিস জাপানী বোমার ভয়ে ভারতের সিমলায় স্থানান্তরিত হয়। অনেক বাস্তুচ্যুত পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবি জানিয়ে বৃটিশ ভাইসরয়কে সিমলায় দরখাস্ত জমা দেয়। আমার বাবাও অত্যন্ত সুন্দর হস্তলিপি ও সাবলীল ইংরেজিতে একটা দরখাস্ত পোস্ট করেন কাটিরহাট থেকে ৬ আগস্ট ১৯৪৪ সাল। আশ্চর্যজনকভাবে সিমলা থেকে ২৫ দিনের ব্যবধানে ৩১ আগস্ট ফিরতি চিঠি পান বাবা। আজকাল আমরা ডিজিটাল যুগের কথা বলি। কিন্তু ২৫ দিনে কিভাবে এই চিঠি সিমলায় পৌঁছল ও উত্তর আসল এটা আমার কাছে ঊভভরপরবহঃ প্রশাসনের একটা বড় আশ্চর্য হয়েই রইল। সম্পত্তি উদ্ধারের চেষ্টা আমার বাবা ১৯৫৪ সাল অর্থাৎ বার্মিজ জাতীয়করণের পাঁচ বৎসর পরেও চালিয়ে যান। তখন চট্টগ্রাম রেঙ্গুনফ্লাইট ছিল। সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য বাবা বার্মিজ হাইকোর্টে মামলাও করেন। এক পর্যায়ে বার্মিজরা উনাকে ভয় দেখায় যে আর যদি সম্পত্তি উদ্ধারের মামলা চালায় তাহলে জানে শেষ করে ফেলা হবে। পরিবারের একমাত্র সন্তান। বার্মা শোকে দাদা মারা যান ১৯৪৯ সালে। সেই শোক নিয়ে প্রজন্ম এখনো বেঁচে আছি।

এভাবে বার্মার সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষ করে চট্টগ্রামের অনেক পরিবারের ভাগ্যবিড়ম্বনার কাহিনী জড়িত। সময় বয়ে যায়। মানুষ স্মৃতি বংশ পরম্পরা বহন করে।

লেখক :কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন শিক্ষাক্রমের সঠিক বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব