ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৩ আগস্ট, ২০২২ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

বাল্যশিক্ষা : আইল অফ ওয়াইট

আমাদের যাদের বয়স ৭০ এর উপরে নিচে ওদের বাল্যকাল ছিল আনন্দময়, কারণ প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা, প্রকৃতির মাঝে খেলাধুলা, কোক-ফান্টা -চকলেটবিহীন খাদ্য তালিকায় প্রকৃতির হরেক রকমের দেশীয় ফলমূল ছাড়া আর কিইবা থাকতে পারে। বাল্যকালের অর্থাৎ প্রাথমিক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার আগে শিশু পাঠ ছিল ‘বাল্যশিক্ষা’। তখন ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের শৈশব, তাই সব কিছুতেই একটু ধর্মীয় মিশ্রণ ছিল। বাল্যশিক্ষা দুই রকম ছিল। একটি সনাতন ধর্মীয় ভাবধারায় শ্লোক-ছড়া সম্বলিত। তার নাম ছিল রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা। এটার বানান পদ্ধতি কঠিন ও সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য। আরেকটি ছিল মোছলেম (মুসলিম নয় তখন মোছলেম বানান লেখা হতো) বাল্যশিক্ষা। সেটার বানান পদ্ধতি সহজ। ইসলামিক বারো মাসের নাম- ইত্যাদি। কঠিন বানান শিক্ষার জন্য অনেকে রামসুন্দর বসাক ও মোছলেম বাল্যশিক্ষা দুইটাই পড়তো। এরা হত বাংলা ভাষায় পাক্কা ছাত্র। মোছলেম বাল্য শিক্ষার প্রচ্ছদের পর পৃষ্ঠার রানী ভিক্টোরিয়ার এক পূর্ণ পৃষ্ঠার ছবি ছিল। আমি শুধু চিন্তা করতাম এত মোটা মহিলাও দুনিয়ায় আছে। রানী ভিক্টোরিয়ার আরো একটি স্মৃতি ছোট কাল থেকে শুনে বড় হয়েছি। রানী বার্মা সফর করেছিলেন, সেই সফরে কোন নেটিভ এর সাথে রানী সাক্ষাৎ করেননি। কিন্তু ফটিকছড়ির জনাব আব্দুল বারী চৌধুরী তখন রেঙ্গুনের বিখ্যাত ধনী। তার সাথে রানীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি রানীকে একটি বার্মিজ ‘শ্বেত ভাল্লুক উপহার’ দিয়েছিলেন। আরো বড় হয়ে লম্বা বাঁশের অ্যান্টেনা দিয়ে বাবার জন্য একটা মার্কি রেডিও এনেছিলেন আমাদের এলাকার এক নাবিক। ওটাই সম্ভবত এলাকার প্রথম রেডিও। ১৯৫৭-৫৮ সাল হবে। ঈদের চাঁদ দেখার সংবাদ শুনলে মানুষজন বলাবলি করত রেডিওর খবরে ঈদ করলে ঈমান থাকবে না।
আরো পরে হাইস্কুলে এসে ইংরেজি প্রথম পত্রে ব্রিটিশ কবি টেনিসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রুডইয়ার্ড কিপলিং প্রমুখ এর ইংরেজি কবিতা পড়ানো হতো। টেনিসনের লেখা একটা কবিতার নাম ছিল “চার্জ অফ দা লাইট ব্রিগেড” রাশিয়ানদের সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় বর্তমান ইউক্রেন এর ক্রিমিয়াম, সেই বীরগাঁথা রচিত হয় টেনিসনের কবিতা।
রানী ভিক্টোরিয়া, রেডিও র আবিষ্কারক মার্কনি কবি টেনিসন এই তিন সম্বন্ধে একটা আবছা ধারণা সেই বাল্যকাল থেকে। আর এই তিনজনেই স্মৃতি বিজড়িত একটি দ্বীপ আইল অফ ওয়াইট (Isle of wight)। এখানে উপরোক্ত তিনজনেরই স্মৃতির এক বিশাল সমাহার।
পুরো-যুক্তরাজ্যই একটা দ্বীপ,এর দক্ষিণ পূর্বের একটা জেলা হাম্পশায়ার। ভৌগোলিকভাবে এই আইল অফ হোয়াইট এই হাম্পশায়ার এর অংশ। মূল ভূখন্ড থেকে ৪৫ মিনিট ফেরিতে পার হয়ে ওয়াইট দ্বীপে যাওয়া যায়। এই ফেরিগুলো কয়েক তলার। নিচে গাড়ি, উপরে যাত্রী, অত্যন্ত সুশৃঙ্খল কারবার। সুবিধাদি নাই বললাম। কিন্তু এই ফেরিগুলো তেমন দামি মনে হলো না। কিন্তু দ্রুত ও বিলাসবহুল। আমাদের নদী বিধৌত এই দেশে ব্যক্তিগত, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কত জৌলুস, কিন্তু আমজনতার জন্য ফেরী হলো সাক্ষাৎ দুর্যোগ। ওয়াইট দ্বীপে অসংখ্য টুরিস্ট। আটলান্টিক সাগরের দ্বীপ। এখানে একেবারে সাগরের তীর ঘেঁষা সাদা পাথরের কিছু পাহাড় আছে। আরেকটা আমাদের দেশের নেত্রকোনার
বিরিশিরি সাদা পাহাড়েরর মত। এই পাহাড়ের নাম ‘নিডলস’’ সকাল দশটার মধ্যেই ফেরিতে পার হওয়া পর্যটকে জনারণ্য হয়ে যায় পুরো দ্বীপ। এই নিডলস এ পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বিনোদন ও আমার বিবেচ্য নয়। এখানে রেডিওর আবিষ্কারক ও নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মার্কোনি রেডিও র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেন।
মার্কোনী সমুদ্রের তরঙ্গ দেখে রেডিওর সিগন্যাল প্রেরণের অনুপ্রেরণা পান। প্রথমে তিনি ১৪ মাইল দূরে বর্ণমাউথ শহর পর্যন্ত রেডিও এবং ওয়ারলেস সংবাদ পাঠান। পরে মার্কোনির গবেষণা দল ৪০ মাইল দূরে জাহাজে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠাতে সক্ষম হন। এই ঘটনায় তাবৎ বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ওয়াইট দ্বীপের নিডলস এ মার্কোনির ভিডিও কেন্দ্র দেখতে আসেন। ১৯০১ সালে প্রথম টান্স আটলান্টিক রেডিও সিগনাল পাঠান মার্কোনি। অর্থাৎ প্রথম বিলাতের সংবাদ, টেলিগ্রাম উত্তর আমেরিকায় প্রচার হয়।
দ্বীপে পশ্চিম কোণায় কবি আলফ্রেড টেনিসনের নামে টেনিসন ডাউন হিল এলাকা নামকরণ করা হয়। তার কাছেই ফারিংফোর্ড হাউজ এ কবি টেনিসন ৪০ বছর সময় কাটান। ১৮২৯ সালে কবি ক্যামব্রিজ গোল্ড মেডেল পান। তার রচিত কবিতা চার্জ অফ লাইট ব্রিগেড আমাদের ছোটকাল হাই স্কুলে পড়ানো হতো। অনেকে বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে এই কবিতা আবৃত্তি করতেন। দুর্ধর্ষ রুশ বাহিনীর কাছে প্রতিকূল অবস্থায় ও ব্রিটিশ সৈন্যরা কামান চালাতে থাকে, এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের মনোজ্ঞ কবিতা এখনো ইংরেজি সাহিত্যে অসাধারণ হয়ে আছে।
রানী ভিক্টোরিয়া ৬৩ বছর ৭ মাস রাজত্ব করেন। তার বিয়ে হয় আলবার্ট এর সাথে। তারা বাকিংহাম প্রাসাদটাকে আয়তনের ছোট মনে করতেন। তাই বসবাসের জন্য ‘আইল অফ ওয়াইট’ এর অসবর্ন এলাকা বিশাল প্রসাদ নির্মাণ করেন। এটার নাম অসবর্ণ হাউজ। তিনি বেশিরভাগ সময় এই গ্রামেই থাকতেন। তার ছেলেমেয়েরা এখানেই বড় হন। রানীর প্রাসাদটা বর্তমানে একটা মিউজিয়াম। রানী এখানেই মৃত্যুবরণ করেন ১৯০১ সালে। পুরা এলাকা আমাদের দেশের দুই তিনটা গ্রামের সমান। মনোরম গ্রামীণ পরিবেশ আর বড় বড় ছায়াদানকারী বৃক্ষ, রানীর গোসলখানা, শোয়ার খাট, ড্রয়িং রুম সবই প্রদর্শন করা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি ম্যানুয়েল একটা লিফট দেখে। এটা শুধু রানীকে উপরের তলায় তোলার জন্য ব্যবহৃত হতো। একটা গ্যালারি হলে রানীর বিভিন্ন সাক্ষাতের ছবিগুলোও আছে। ভারতবর্ষের মহারাজাও আছেন। রানীর ড্রয়িং রুমটা পুরো ডিজাইন করেছেন বেনারসের এক মুসলিম ডিজাইনার। তার ছবিও আছে, পায়ে হাটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই অসবর্ণে।
রানী ভিক্টোরিয়াকে ইউরোপের রাজ পরিবারের ‘দাদি’ বলা হয়। ভিক্টোরিয়া ইউরোপের যত রাজ পরিবার আছে সবার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন বিবাহের মাধ্যমে। রানী ভিক্টোরিয়ার নাতি রাজা জর্জ পঞ্চম এর ভারত আগমন উপলক্ষে তার প্রশান্তি সূচক কবিতা লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জনগণমন ভারত ভাগ্য বিধাতা এটাই হয় ভারতের জাতীয় সংগীত। রানী ভিক্টোরিয়ার ইচ্ছা অনুসারে তার কফিনে ‘স্কটিশ হিদার’ নামে এক বিশেষ ফুল দেওয়া হয় কবরে। এই ফুল স্কটল্যান্ডে পথে ঘাটে পাওয়া যায়। রানী স্কটল্যান্ডে ছুটি কাটাতে পছন্দ করতেন ও এই ফুল তার জন্য রাখা হতো। দুই ছেলে ও চার মেয়ের জননী তিনি। ১৯০১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আইল অফ হোয়াইট মানুষকে ইতিহাসের পাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আটলান্টিক তীর ঘেঁষে অনন্য সৌন্দর্যের একটা দ্বীপ আমাকে নিয়ে যায় বাল্যকালে। বাল্য শিক্ষার ভিক্টোরিয়া স্কুলের টেনিসন আর লম্বা বাঁশের এন্টেনা ওয়ালা মার্কি রেডিওর যুগে, ইতিহাস সত্যিই স্মৃতিগামী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃক্ষের প্রতি যত্নবান হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধঅন্তহীন ভালোবাসায় সেবার অগ্রযাত্রায় যুবসমাজ