লয়ের প্রান্তে মার্কিন দম্ভ
১৯৬০ সালে এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল এদেশে। তখন মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আজকের তরুণদের কল্পনার বাইরে। ঘর বলতে শুধু বাঁশ-মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি।
তখন আমি ২য় শ্রেণিতে পড়ি। বৃষ্টি, বন্যা হলে আমার খুব ভাল লাগত। স্কুলে যেতে হতো না। আমাদের এলাকা এমনিতেই ছিল বন্যা-প্রবণ। এই ভয়াবহ বন্যায় পাড়ায় কয়েকটি ঘর ডুবেনি। আমাদের সামনের বাড়ির খড়ের ছাদের কাছে পানি পৌঁছে গেছে। এই বন্যা আর নতুন বৃষ্টি স্রোত দেখে আমি হাত তালি দিয়ে আনন্দ করছিলাম। আমাদের ভিটা তখনো ডুবেনি, আমার আনন্দটা ছিল সামনের বাড়ির ছাদ বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই, এটা আমার জন্য অত্যাচর্য ব্যাপার। অপরের ঘরের ছাদ ডুবছে অথচ আমি আনন্দে উন্মুখ এটা দেখে বাবা এমনভাবে পিটাল যে জীবনে এখনো সে মার ভুলতে পারিনি।
জীবনের ছয় দশক পরে অন্যের দুঃখ দেখে আমার আবারো যেন ছোটবেলার আনন্দ আমাকে পেয়ে বসল। কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় ধনী দেশ আমেরিকায় মানুষ লম্বা লাইন ধরে দামি গাড়ি করে খাদ্য ভিক্ষা নিতে এসেছে ‘ফুড ব্যাংক’ থেকে। এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। যে দেশ গরিব দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য খাদ্য জাহাজ ডুবিয়ে দিতো সে দেশের মানুষ খাদ্যের জন্য লাইনে। এটা নিছক নিয়তি নয়। এটা অর্থনীতি ও সমাজ বিকাশের একটা ‘স্তর’ মাত্র।
পিটার টারচিন একজন মার্কিন গণিত বিশারদ ও দার্শনিক। আধুনিক সমাজ ও পরাশক্তির উত্থান পতন নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। তিনি গাণিতিক মডেল প্রয়োগ করে ২০১৬ সালে এক বই প্রকাশ করেন। নাম Ages of Discord বাংলায় বিভ্রান্তির যুগ। পিটার টারচিন আমেরিকার শক্তি ও অর্থনীতির পতনের ইঙ্গিত করেন। পিটার এর মতে আমেরিকা অতিমাত্রায় ‘ক্ষমতার এলিট’ পয়দা করেছে বিগত পাঁচ দশকে। যার ফলে ‘এলিট’ ও আমজনতার সংঘ, আবার এলিটের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মার্কিন সমাজের পতন অনিবার্য।
পল কেনেডি নামক বৃটিশ ইতিহাসবিদ মানব সভ্যতার ইতিহাস ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেছেন। পল কেনেডির একটা বই Rise and fall of great power। এই বইয়ে চৈনিক সভ্যতা থেকে গ্রীক, মিশরীয় সভ্যতা শুরু করে আধুনিক ফ্রান্স, বৃটিশ, সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বশেষ মার্কিন পরাশক্তির উত্থান ও পতনের বিশ্লেষণ করেছেন। পল কেনেডির মতে সাম্রাজ্য বা পরাশক্তি গড়ে ১০ প্রজন্ম স্থায়ী হয়। এরপর সাম্রাজ্যের বা পরাশক্তির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
বৃটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ হ্যারলড লাসকি অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি একদিকে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস এর প্রফেসর ছিলেন। আবার লেবার পার্টির প্রধানও ছিলেন। তিনি ১৯১১ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে বৃটিশ সাম্রাজ্য আরো ৫০০ বছর স্থায়ী হবে। কিন্তু ৩৫ বছরের মধ্যে তাদের সাম্রাজ্যের নক্ষত্র অর্থাৎ ভারত হারায়। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে বৃটিশ পরাশক্তির চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে। করোনা শুরু হওয়ার আগেই অমেরিকার পতন শুরু হয়। সাময়িকভাবে সিরিয়া থেকে কিউবা ভেনুজিয়ালা, আফগানিস্তান কোথাও সাময়িক প্রাধান্য বজায় রাখতে পারেনি।
অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত বাণিজ্য চালু হওয়ার পর থেকে মার্কিনীদের ওপরের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সম্পদ স্ফীত হতে থাকে। বৃহত্তর নাগরিক সমাজের আয় ও জীবন যাত্রার মান সেই অনুপাতে বাড়েনি। এখানেই বলা হচ্ছে Overproduction of Economic Elite বা একটি সুবিধা ভোগী বিত্তশালী গোষ্ঠী। এরা রাষ্ট্রীয় নীতি নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের অনুকূলে চালিত করে। আমজনতা হয় দারুণ বৈষম্যের স্বীকার। এর সাথে যুক্ত হয় চীনের অপ্রতিরোধ্য বাজার দখল। অর্থনীতি ও সমরনীতির এমন তালমাটাল অবস্থায় শুরু হয় কোভিড-১৯ এর হানা। তছনছ হয়ে যায় মার্কিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখে মার্কিন বৈষম্য।
কোভিড-১৯ এর শুরুতেই মার্চ এপ্রিলে ‘কেয়ার লিলিফ’ প্রণোদনার মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের ক্যাশ ডলার দেয়া হয়। এই ক্যাশ ডলার না পেলে ১৮ বিলিয়ন আমেরিকান দারিদ্র্যে পতিত হয়। মে মাসে গিয়ে আরো ১২ মিলিয়ন লোক চরম দারিদ্র্যে পতিত হয়। অক্টোবরে ২ কোটি আমেরিকান চরম দারিদ্র্যে পতিত হয়।
মার্কিন ‘ইনটেলেক্টরও এক নড়বড়ে অবস্থা। ৩৮% মার্কিনী কোভিড-১৯ টিকা নিবে না বলেছে। আবার মার্কিন ওষুধ কোম্পানি ফাইজার এর ভ্যাকসিন নিয়ে খোদ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের ‘এথিকেল’ বিজ্ঞানীরা সন্ধিগ্ধ। কারণ এক একটা ভ্যাকসিন বানাতে অতীতে ১০-১৫ বছর লেগেছে। আবার ম্যালেরিয়া, এইডসসহ কয়েকটা রোগের ভ্যাকসিন ৩০ বছরেও সম্ভব হয়নি। ফাইজার কি করে কয়েক মাসেই এনিম্যাল ট্রায়াল, হিউমান ট্রায়াল করল তার সন্দেহ থেকেই যায়। যে তড়িঘড়ি করে মার্কিন মুলুকে এই ভ্যাকসিন অনুমোদন পেয়েছে তাও ব্যতিক্রমী ঘটনা। আরও ভয়ের কারণ হচ্ছে যে ‘ফাইজার’ বিশ্বের দু-তিনটি সেরা কোম্পানির মধ্যে গণ্য হলেও ওষুধের ইতিহাসে ফাইজার সবচেয়ে বেশি জরিমানা দেওয়া কোম্পানি। ডা. যোশেফ মার্শেল ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক মুনাফা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগাগোড়া সোচ্চার। তার মতে ২০০৮ সালেই ৬৪৮৫টি অনৈতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে আমেরিকায়। মানুষের জীবনের বিনিময়ে ওষুধ কোম্পানি মুনাফা করেছে। নাইজেরিয়ায় ১১ জন শিশুর মৃত্যুর জন্য ফাইজার বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়। FDA অনুমোদন ছাড়াই বাত ও মহিলাদের ঋতুস্রাবজনিত ব্যথার ওষুধ বাজারজাত করার জন্য ‘ফাইজার’ কোম্পানিকে ২০০৯ সালে ২-৩ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়।
বাংলাদেশেও এরশাদ আমলের নন্দিত ‘ওষুধনীতি’ বাস্তবায়ন না করার জন্য মাল্টিন্যাশনাল ফাইজারসহ কয়েকটি কোম্পানির চাপ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার লিখিত বই Politics of Drugs Policy নামক গ্রন্থে।
মোটামুটি আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে বর্তমান মার্কিন সমাজ। কোভিড-১৯ মার্কিনীদের সম্মান ও বিত্তে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে- এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বিশ্ব ইতিহাস সামাজিক ও দ্বান্দ্বিক সমাজবাদেই পরিবর্তিত হয়। কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপরীতমুখী গোষ্ঠীর অবস্থান উন্মোচন করেছে। রাষ্ট্রের অবহেলিত জনগণকে বাদ দিলে পতন হবেই, অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও চিকিৎসক।