বাজার, টোল ইজারা : প্রাসঙ্গিকতা
নিজের বাজার নিজে করা আমার স্বভাব। তাও বাজার করা হয় ভোর সকালে। অর্থাৎ সকাল ৮ টার মধ্যেই মাছ–মুরগী কেনা শেষ। তারপর সারাদিন পেশাগত কাজ করতে হয়। গত কয়েকদিন আগে সকালে বাজার করতে গিয়ে দেখি ৩–৪ জন নেতা টাইপের লোক প্রতিটি দোকানে গিয়ে দোকানীকে আগে কত ভাড়া দিত তা জানতে চাইছে। অসহায় দোকানী ভাড়া ১০০ টাকা বললে নেতা টাইপের লোকগুলো বলছে সামনের মাস থেকে ২০০ টাকা, কেউ ভাড়া ৩০০ টাকা বললে তাকে বলছে সামনের মাস থেকে ৫০০ টাকা ইত্যাদি। উল্লেখ্য এই ভাড়াটা দৈনিক। দোকানীরা কেউ মুরগীর দোকানী, কেউ শসা, কাঁচামরিচ, লেবুর দোকানী, কেউ সবজির দোকানী। অর্থাৎ একজন মুরগীর দোকানীর মাসিক ভাড়া পনর হাজার টাকা, একজন কাঁচা মরিচ বিক্রেতার মাসিক ভাড়া ৬–৭ হাজার টাকা, সবজি বিক্রেতার মাসিক ভাড়া দশ হাজার টাকা, নেতা টাইপের লোকগুলো চলে গেলে দোকানীদের জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা? দোকানীরা বলল এরা নতুন ইজারাদার। এদের সাথে কোন দরকষাকষি চলে না। এরা যেই ভাড়া বলে ঐ ভাড়া দিতেই হয়। একজন মুরগীওয়ালা বা সবজি বিক্রেতার মাসিক ভাড়া ১০–১৫ হাজার টাকা দেয়ার পর তার নিজের বেতন, কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ, আলো, ফ্যান নিজ খরচায় দিয়ে তার আদৌ কত লাভ হয় তা ভেবে দেখার বিষয়। ৪–৫ জনের পরিবার ব্যবসার লাভে চলে কিনা এটা কে ভাবে? অর্থাৎ বাচ্চার খরচ, আপদ বিপদের খরচ এসব নিয়ে এসব দোকানীর প্রতিটি সকাল এক অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে।
বাংলাদেশে সরকারী চাকরির সংখ্যা ১৫–২০ লাখ। বেসরকারী চাকরিজীবীর সংখ্যা গার্মেন্টসহ ৪০–৫০ লাখ। বাকী সমস্ত জনগণ ইনফরমাল সেক্টরে নিয়োজিত। এরা স্ব উদ্যোগী মানুষ। এদের ব্যবসাতে ঘুষ–দুর্নীতি কম। এরা সবাই ক্ষুদ্র স্ব–উদ্যোগে ব্যবসা না করে মাদক ব্যবসায়ী–ছিনতাইকারী গুন্ডা বদমাইশ হতে পারত। এসব স্বউদ্যোগী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তি। অথচ তাদের প্রতি ভর্তুকী তো দূরের কথা–বিভিন্ন আর্থিক কর ভাড়া ইজারাদার কর্তৃক আরোপিত কর ইত্যাদি তাদেরকে আর্থিকভাবে একটি বিপর্যস্ত বৃত্তের মধ্যে বন্দী করে রাখে।
ইজারা কি? আমাদের দেশের একটা বড় দুর্ভাগ্য যে এখনো বৃটিশ প্রবর্তিত অনেক আইন স্ব–মহিমায় এখনো বহাল। বৃটিশদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এদেশের মানুষ থেকে মুনাফা করা। আমাদের দেশে হাট–বাজার–ঘাট ইত্যাদি ‘ইজারা’ দেয়া হয়। ‘ইজারা’ স্থায়ী সম্পদের থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থায়নের একটা সহজ পন্থা জনগণ থেকে ‘মিডল ম্যান’ পন্থায় দিল্লীর সুলতানরা অর্থ সংগ্রহ করত ইজারার মাধমে। জনগণের ওপর ‘মিডলম্যানরা’ বা ইজারাদাররা ইচ্ছামত ভাড়া/কর আদায় করত। কারণ এতে তার নিজস্ব লভ্যাংশ ও বাদশাহকে দেয় টাকাও অন্তর্ভুক্ত হত। শেরশাহ ও আকবর এর সময় ‘ইজারা’ প্রথা জনস্বার্থে শ্লথ করা হয়। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর পুনরায় ‘ইজারা’ প্রথা চালু করেন। এসময় থেকেই ‘ইজারায়’ শহরে অর্থলগ্নিকারীদের প্রবেশ ঘটে যা এখন অবধি চলছে। ইজারা প্রথার মাধ্যমেই ‘জমিদারীর’ সৃষ্টি হয়। ১৭৭৩ সালে বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য হাট–বাজার–ঘাট–ইত্যাদি ইজারা দেওয়া বিধিবদ্ধভাবে শুরু হয়। এতেও সাধারণ দোকানী কৃষিজীবীদের ওপর মারাত্মক বিপদ নেমে আসে।
বর্তমানে ‘ইজারা’ অনেক নীতিমালায় বিধিবদ্ধ। প্রাপ্ত অর্থ কোন স্থানীয় পরিষদ কত পার্সেন্ট পাবে তাও বর্ণিত। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ইজারা থেকে প্রাপ্ত অর্থে পরিচালিত হয়। এ সবই ভাল। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের ‘মিডলম্যান’ কেন প্রয়োজন? সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জনগণ থেকে বিভিন্ন উৎসের কর/ ভাড়া সংগ্রহ করে। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে যে কোন স্থানীয় হাট–বাজার–দোকানে সরকার নিজেই ‘মিডলম্যান’ ছাড়াই একাজ করতে পারে। মিডলম্যানরা মুরগীর দোকানে দৈনিক ৩০০ টাকা থেকে ভাড়া ৫০০ টাকা করে ফেলে। সরকার অনেক কম টাকায় এ অর্থ পেতে পারে ‘মিডলম্যানদের’ অর্পিত ভাড়া মূল্যবৃদ্ধি আকারে আম–জনতার উপরই পড়ে। এই কাণ্ড দেশের সড়ক পথের টোল থেকে–কোরবানীর পশুর বাজার সবখানেই চলে। ঔপনিবেশিক আমলের রাজা–বাদশাহর আমলে একটা প্রথা গণপ্রজাতন্ত্রী একটা স্বাধীন দেশে কেন চলছে তা নিয়ে স্টোক–হোলডারদের সাথে বসা প্রয়োজন। কম্পিউটারের এক ক্লিকে যদি জমির দশ টাকা খাজনা শোধ করা যায় তা হলে কেন হাট–বাজার–ঘাট–রাস্তার টোল প্রযুক্তি নির্ভর করা যাবে না? তাহলে কেন মিডলম্যান ৩০০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা আর ১০০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকা করতে পারবে না।
মিডলম্যান প্রথা এবং বিনাশ্রমে মুনাফা অর্জন ধনবাদী ও পচনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চলে। যে সরকার বৃদ্ধভাতা, বিধবা ভাতার মত জনকল্যাণকর নীতিমালা গ্রহণ করে সে সরকার এর কাছে মুরগীর দোকানী, কাঁচা মরিচের দোকানীর ও করের ভাড়ার বোঝা থেকে লাঘবের প্রত্যাশা থাকতেই পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট চিকিৎসক।