ভাষা আন্দোলনে নারী

ড. সেলিনা আখতার | সোমবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

পূর্ব প্রকাশিতের পর
১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদের নেতৃত্ব দেন শাফিয়া খাতুন। তিনি ১৯৫০-৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওমেন হলের জি. এস. এবং ১৯৫২-৫৩ সালে ভি.পি.-র দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সচেতন অনুভুতি নিয়ে। ছাত্রীদের প্রথম দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন। ২১ ফেব্রুয়ারির অবিস্মরণীয় উত্তেজনাপূর্ণ মহূর্তে আরো যারা ছাত্রীদের প্রথম দলে বা অল্প ব্যবধানে সেই ঐতিহাসিক মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন তারা হলেনঃ সুরাইয়া হাকিম, শরিফা খাতুন, জাহানারা লাইজু, জুলেখা হক, সুফিয়া খান, কাজি খালেদা খাতুন, গুলে ফেরদৌস, সামসুন্নাহার, সারা তৈফুর, কাজী আমিনা, মাহফিল আরা, খুরশিদা খানম, নাদিয়া চৌধুরি সহ অনেকে। পুলিশ ব্যারিকেড দিলে অনেক মেয়ে লাঠির ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে চলে যায়। রওশন আরা বাচ্চু তা না করে আরো কয়েজন ছাত্রী নিয়ে পুলিশের লাঠির ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলেন। পুলিশ এ দৃশ্য দেখে পাগলের মতো এলাপাথাড়ি পেটাতে থাকে এতে তিনি আহত হন এবং উপায়ান্তর না দেখে স্তুূপীকৃত রিঙার নিচে আশ্রয় নেন। তারপর তিনি কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ডক্টর গণির বাসায় আশ্রয় নেন। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেকেই আহত হন এর মধ্যে সারা তৈফুর, সুফিয়া খাতুন, সুরাইয়া হাকিম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নাদিরা চৌধুরী পুলিশের গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেছিলেন। কবি সুফিয়া কামালের বোনের পরিচয়ে তার বাসায় থাকতে শুরু করেন তিনি। নাদিরা চৌধুরীর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় জাহানারা। মুনীর চৌধুরীর বোন ছিলেন এই নাদিরা। কিছুদিন পর ঘটনাটি জানাজানি হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কারাগারে অন্য বন্দীদের সঙ্গে তিনি কঠোর নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হন।
আরেকজন ভাষা সৈনিক রওশন আরা চৌধুরী। যখন টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ চলছিল তখন তিনি আরো কয়েজন ছাত্রী নিয়ে কলা ভবনের ভেতরে ঢুকে যান। পরক্ষণেই দেখেন গণগ্রেফতার চলছে। দুটি গাড়ি বোঝাই করে ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হল। ২৫ জন ছাত্রীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাগ থানায়। রওশন আরা চৌধুরী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ”তখন দুপুর বারোটা। রাজবন্দিরা যে ওয়ার্ডে থাকত, সেখানে ২৫ জন মেয়েকে রাখা হল। তখন সন্ধা। ক্ষুধায় পেট জ্বলছিল। অনেক মেয়ে বন্ড সই দিয়ে মুক্তি পেয়ে চলে গেছে”। রওশন আরা এতে রাজি না হওয়ায় তাকে ১২ দিন জেলে কাটাতে হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষণের পর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে এর প্রতিবাদে প্রথম যে মহিলা বক্তব্য রাখেন তিনি হলেন মিসেস আনোয়ারা খাতুন। মেয়েদের উপর পুলিশি জুলুম সম্পর্কে পরিষদে বলেনঃ “ঘটনা দেখে মনে হয় আজও আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাই নাই। তার প্রমাণ এই পুলিশি জুলুম। এ অত্যাচার থেকে মেয়েরা পর্যন্ত রেহাই পায় নাই… ছেলেদের কথা আর নাই বল্লাম… যে জাতি মাতৃজাতির সম্মান দিতে জানে না সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। এ অত্যাচারের বর্ণনা দেয়া সম্ভবপর নয়… দু’একটি কথায় কিছুটা পরিস্কার করতে চেষ্টা করব… মিলিটারি মেয়েদের গাড়িতে করে কুর্মিটোলা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। যে মিনিস্ট্রির আমলে এই সমস্ত অত্যাচার হয় যারা মাতৃজাতির সম্মান দেয় না তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। পুলিশের লাঠিচার্জে মেয়েরা উন্ডেড হয়েছে। আমি তাদের মধ্যে দু’জনের নাম দিচ্ছি। একজন হল ঢাকা হাইকোর্টের জাস্টিস ইব্যাহীম সাহেবের মেয়ে মিস সুফিয়া ইব্যাহিম আর একজন হলো মিস রওশন আরা থার্ড ইয়ার বি.এ.। মেয়েদের টোটাল উন্ডেড এর সংখ্যা হল ৮ জন।” মিসেস আনোয়ারা খাতুন সমস্ত গ্রেফতারকৃত বন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি, আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ, হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিচার, সরকারের দমননীতি বন্ধের দাবি জানান।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণের পর নারীরা বিভিন্ন স্থানে সভা করে এর প্রতিবাদ জানায়। ২২ ফেব্রুয়ারি শাফিয়া খাতুন এর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রী ও নাগরিকদের উপর সরকারের অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদ, নিন্দা এবং সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আজিমপুর কলোনির মেয়েরা একটি প্রতিবাদ সভা সংঘটিত করেন। এই সভায় কমলাপুর ও অন্যান্য দূর এলাকা থেকে মেয়েরা এসে যোগদান করেন। কয়েক হাজার মহিলা এই সভায় একত্রিত হয়ে সরকারের বর্বর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ২৫ তারিখেও আজিমপুর কলোনিতে মহিলাদের অনুরূপ একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় সভায় নুরুল আমিন সরকারের ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে অবিলম্বে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, ১৪৪ ধারা ও সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার এবং সমস্ত রাজবন্দীদের অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার রূপে গ্রহণ না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ববঙ্গের জনগণকে অনুরোধ জানানো হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ১২ নাম্বার অভয় দাস লেনে এ সভায় নেতৃত্ব দেন বেগম সুফিয়া কামাল ও নূরজাহান মুরশিদ। আন্দোলনে কোমলমতি কিশোরীরাও অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনে কিশোরীদের অংশগ্রহণের দালিলিক উপাদান পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল তার নাম ৪ নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান ও দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, ্‌আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতোনা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’,… নানা ধরনের স্লোগান।” ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকে পোস্টার-ফেস্টুন লিখে এবং বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে প্রাণের সঞ্চার করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঢাকার ইডেন কলেজ এবং কামরুন্নেসা স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল সংগ্রামী। ভাষা আন্দোলনের একজন প্রখ্যাত সৈনিক মনোয়ারা ইসলাম ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রী। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। হোস্টেল থেকে দেয়াল টপকে বের হয়ে যান মনোয়ারা। এক দৌড়ে চলে যান মেডিকেলের সামনে। যেসব ছাত্ররা গ্রেফতার হয়ে জেলে গিয়েছিলেন তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি নাজিমুদ্দিনের পল্টন বক্তৃতার পর পরবর্তী পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরীতে একটি সর্বদলীয় সভা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় অন্যান্যদের সাথে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত দেবে।’ এ সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এর অন্যতম সদস্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য মিসেস আনোয়ারা খাতুন।
ভাষাসৈনিক কবি ও কথা সাহিত্যক চেমন তার এক নিবন্ধে লিখেছেন ‘ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মৃতিতে আসলে মনে পড়ে ইতিহাসের আড়ালে ঢাকা তিনজন নারীর কথা। ১৯ নং আজিমপুরের অন্দরমহল ছিল এই তিন নারীর কর্মশালা। কোনরূপ মিটিং, মিছিলে অংশ না নিয়ে তিন নারী দিনের পর দিন তমুদ্দুন মজলিশের বিপ্লবী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ কিছু তররুণের উৎস ছিলেন। এই তিনজন হলেন রাহেলা খাতুন, রহিমা খাতুন ও রোকেয়া বেগম। রাহেলো খাতুন ছিলেন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের স্ত্রী, রহিমা খাতুন ছিলেন তাঁর বোন এবং সাহিত্যক সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরীর স্ত্রী। রোকেয়া বেগম ছিলেন আবুল কাসেম সাহেবের সম্বন্ধির স্ত্রী। রোকেয়া বেগম হাসিমুখে প্রতিদিন ২০-৩০ জন মানুষের রান্নার কাজ করতনে এবং এ কাজে সাহায্য করতেন রাহেলা খাতুন। রহিমা খাতুন ও রাতের কর্মের সঙ্গি ছিলেন। রাত দুইটার আগে এই তিন নারীর ঘুমানোর সুযোগ হতোনা, মজলিস কর্মীদের হৈ-হুল্লোড়, গন্ডগোলের জন্য। এই কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যেও এই তিন নারী ভাষা আন্দোলনকে বেগবান রাখতে নিজেদের সব রকমের শারীরিক ও মানসিক শান্তিকে দূরে রেখে অবিরাম তমুদ্দুন মজলিশের দূর প্রবাসী কর্মী ভাইদের সুখ সুবিধার প্রতি সচেষ্ট থাকতেন।
উল্লেখিত নারীরা ছাড়াও আরো কিছু নারীর কথা জানা যায় আতাউর রহমান খানের সাক্ষাৎকার থেকে। তিনি বলেছেন, ”একুশে ফেব্রুয়ারির দুই তিন দিন পর তারা কয়েকজন আজিমপুর কলোনিতে গিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের চাঁদা তুলতে। সেই সময় অনেক মহিলা তাদের প্রিয় সোনার অলংকার যেমন আংটি, কানের দুল, গলার হারও দিয়ে দিয়েছিলেন”। ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে আবির্ভ্থত হন মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। সভা সমাবেশে তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের অভিযোগে ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ মমতাজ বেগমকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রথমে চাকরীচ্যুত ও পরে গ্রেফতার করে। মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বকশী, রেনু ধর ও শাবানীর মতো কিশোরীকেও সেদিন করাবন্দি করা হয়। মমতাজ বেগম সহ গ্রেফতারকৃত ছাত্রীদেরকে রাখা হয় ঢাকা জেলের পাগলা গারদে। সেখানে আগে থেকেই গ্রেফতার ছিলেন নাচোলের রানী ইলা মিত্র। মমতাজ বেগম সহ গ্রেফতারকৃত ছাত্রীদেরকে রাজবন্দীর মার্যাদা দেওয়ার জন্য জেলেই আন্দোলন শুরু করেন ইলা মিত্র। পরে জেল কর্তৃপক্ষ তার দাবি মেনে নেয়। কারাবন্দি মমতাজ বেগম বন্ড সই করে মুক্তি লাভে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর স্বামী তাঁকে তালাক দেন। একদিকে করাবন্দিত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা, অন্যদিকে সংসার ভাঙ্গার বেদনা; তবুও মায়ের ভাষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন।
বিপ্লবের দেশ, বিদ্রোহের দেশ চট্টগ্রাম। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে যে কোনো সময়ে চট্টগ্রামের ভূমিকা অগ্রগামী। ভাষা আন্দোলনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামেও বেশকিছু কলেজ ছাত্রী এবং অনেক সম্ভ্রান্ত মহিলা যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে তোহফাতুন্নেছা আজিম, সৈয়দা হালিমা, সুলতানা বেগম, নুরুন্নাহার জহুর, আইনুন নাহার, আনোয়ারা মাহফুজ, তালেয়া রহমান ও প্রতিভা মুতসুদ্দি অন্যতম। চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, মিছিল এবং লালদীঘি ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাত দিন পুলশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়। মিরা সেন, জাহানারা রহমান, জওশন আরা রহমান, হোসনে আরা প্রমুখ চট্টগ্রামে পোস্টার লেখা ও লাগানোর কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, “আমি পোস্টার লিখতে পারতাম না। অন্যরা যেগুলো লিখত তা দেয়ালে দেয়ালে লাগাতম। মিটিং-মিছিলে বক্তৃতা দিতাম। এভাবেই চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগঠন করি।” ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রতিভা মুৎসুদ্দি, তালেয়া রহমান প্রমূখ ছাত্রীরা একটি ছোট্ট মিছিল নিয়ে ডা. খাস্তগীর স্কুলে আসেন। সেখান থেকে জাহানারা রহমান, হালিমা খাতুন সহ অন্যান্যরা মিছিলে যোগ দেন। এরপর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরাও যোগ দেন। মিছিলকারী ছাত্রীরা ট্রাকে করে চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করেন। পরে এক সমাবেশে ছাত্রীরা ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবি করেন। গণপরিষদ কর্তৃক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস। আন্দোনের মূর্ত প্রতিক। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ শহীদ মিনারে এসে টাকা পয়সা রেখে যান। শহীদ মিনারে প্রথম স্বর্ণালঙ্কার প্রদান করেছিলেন ড. আনিসুজ্জামানের মাতা সৈয়দা খাতুন।
সিলেটে মেয়েরা ভাষা আন্দোলনে গৌরবজনক অবদান রাখেন। মহিলা কংগ্রেস নেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরী সেখানে প্রধান ভুমিকা পালন করেন । ১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী আবদুর রব সিলেটে আসলে জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একই মাসে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সহ সভানেত্রী শাহেরা বানু, সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খানম, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন ও রাবেয়া খাতুন ভাষার পক্ষে স্মারকলিপি প্রদান করেন। তাঁদের এ স্মারকলিপির বিরুদ্ধে সিলেটের সাপ্তাহিক হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অশোভন মন্তব্য করা হয়। এ অশোভন মন্তব্যের প্রতিবাদ করে সিলেট মহিলা সংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদিকা সৈয়দা নজিবুন্নেসা বলেছিলেন, ”যাহারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হইয়া মাতৃবাষার বিরুদ্ধাচরণ করেন তাহারা মাতৃভাষার বিশ্বাসঘাতক কু-পুত্রতুল্য”। অন্যদিকে সিলেটের কুলাউড়ার মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছালেহা খাতুনকে স্কুলে কালো পতাকা উত্তেলনের দায়ে তিন মাসের জন্য বহিস্কার করা হয়। তখন ছালেহা খাতুনের পক্ষে আর লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। টাঙ্গাইলে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন নুরুন্নাহার বেলী ও রওশন আরা শরীফ। খুলনাতেও কাজ করেছেন তমুদ্দুন মজলিসের কর্মী আনোয়ারা বেগম, সাজেদা আলী এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরা।
ভাষা অন্দোলনের শুরু থেকেই যশোর জেলায় ভাষা আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। যশোরের নারীনেত্রী হামিদা রহমান শুরু থেকে পত্র পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে ভাষার পক্ষে জনমত গঠনে ভ্থমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালে আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে একটি লেখা প্রকাশ পেলে তিনি প্রতিবাদ করে একটি নিবন্ধন লেখেন। পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। যশোরের ঝালপট্টি পতিতালয়ের মেয়েদের অবদান স্বর্ণজ্বল হয়ে লেখা রয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের ঘিরে ফেললে ছাত্ররা ঝালপট্টি পতিতালয়ে আশ্রয় নেয় এবং পতিতালয়ের মেয়েরা প্রায় ৪০ জন ছাত্রকে একটি ঘরে লুকিয়ে রেখে তালাবদ্ধ করে তাদেরকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া থেকে রক্ষা করে। কুমিল্লার লায়লা নূর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন কিশোরী বয়স থেকে। ১৯৪৮ সালে কুমিল্লা শহরে একটি স্কুলে ১০ম শ্রেণীতে পড়তেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতেন। সাতক্ষীরায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের ভূমিকা রাখেন গোল আরা বেগম ও সুলতানা চৌধুরী। বগুড়ায় মহিলাদের মধ্যে রহিমা খাতুন, সালেহা খাতুন ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ভাষার অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সালেহা খাতুন মুসলিম উগ্র সমর্থকদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালণ করেন ড. জাহানারা বেগম বেনু, মনোয়ারা বেগম, ডা. হাসিনা বেগম ফুলু, হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম ডলি, রওশন আরা, খুরশিদা বানু খুকু, আখতার বানু প্রমূখ। রংপুরে নিলুফা আহমেদ, মালেকা আশরাফ, আফতাবুন্নেসা প্রমূখ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিলে গুলবর্ষণের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন। দিনাজপুরে নবুতুন নেসা, জোবেদা রহিম, আমিনা খাতুন ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের ২ মার্চ আমিনা খাতুন পুলিশের গ্রেফতারের শিকার হন। নড়াইলে দিলরুবা, বেবি, রেজিয়া, রুবি, শেফালী ও বুলবুল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিলে নেতৃত্ব দেন। চুয়াডাঙ্গায় রেবা, বেলি প্রমূখ ছাত্রী ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে বেলির লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। বরিশালে ২২ ফেব্রুয়ারি সম্মিলিত মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন হোসনেআরা, মঞ্জুশ্রী, মাহে নুর বেগম ও রানী ভট্টাচার্য।
১৯৫৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রীনিবাসগুলোর ছাদে কালো পতাকা উড়িয়ে দেন শিক্ষর্থীরা। রাতেই সেনাবাহিনীর লোকেরা বেআইনিভাবে ছাত্রদের আবাসিক হল ও ছাত্রীনিবাসে ঢুকে জোরপূর্বক পতাকাগুলো নামিয়ে দেয়। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এতে বেশি ছাত্রী গ্রেপ্তার হয়েছিল যে, তাঁদের জন্য লালবাগ কেল্লার তখনকার পুলিশ সদর দপ্তরে তাঁর খাটিয়ে অস্থায়ী জেলখানা স্থাপন করতে হয়েছিল। সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে লয়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, রওশন আরা বেনু, ফরিদা বারি, জহরত আরা, কামরুন নাহার লাইলি, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার ও তালেয়া রহমান অন্যতম। কুমিল্লার মেয়ে লায়লা নূর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। পরবর্তীতে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম নারী অধ্যাপক হয়েছিলেন।
পঞ্চাশের দশকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি সমাজে নারীদের রাজপথে নামা মোটেই সহজ ছিল না। তাই বাঙালি নারীর অগ্রগতির বড় ধাপ হলো ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনা। ভাষা আন্দোলনে কারাবরণকারীসহ সকল নারী ভাষা সৈনিক আমাদের গর্ব। আমাদের আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করতে ভাষা আন্দোলনে নারী সমাজের কীর্তিগাঁথা তুলে ধরা খুব জরুরি। প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাস এলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, বাংলা একাডেমী, স্কুল কলেজ, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে সভা-সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এসব আলোচনায় নারী ভাষা সৈনিকদের ভূমিকা যথাযথভাবে উঠে আসে না। এমনকি বই-পুস্তকেও ভাষা আন্দোলনে তাঁদের কীর্তিগাথার স্বীকৃতি অপ্রতুল। অথচ এ আন্দোলনে নারীর ভূমিকা গৃহিণী থেকে শুরু করে গণপরিষদের সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আমি এ মহীয়সী নারীদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
লেখক : প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়: গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক
পরবর্তী নিবন্ধশবে মিরাজ ইতিহাসে বিস্ময়কর ঘটনা