শবে মিরাজ ইতিহাসে বিস্ময়কর ঘটনা

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ | সোমবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

জগতের ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী, অলৌকিক ও বিস্ময়কর ঘটনা মিরাজ। আজ ২৬ রজব সোমবার দিবাগত রাত পবিত্র শবে মিরাজ। মিরাজ বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। এ মিরাজ অন্য কোনো নবীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। মিরাজ রাসুল (সা.)-এর এমন মুজিজা যাতে তিনি অনন্য।
মিরাজ আরবি শব্দ । এটি আরবি ‘উরুজুন’ শব্দ থেকে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আরোহণ, সিঁড়ি, উত্থান, সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থানে সমাসীন হওয়া ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়- বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে উপনীত হয়ে সেখান থেকে সপ্ত আকাশ ভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার ঘটনাকে মিরাজ বলা হয়। রাসুল (সা.)-এর মক্কি জীবনের প্রায় শেষলগ্নে নবুওয়াতের দশম বছরে ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ৬২১ খ্রিস্টাব্দে রজব মাসের ২৭ তারিখ সোমবার রাতে বিশ্বের ইতিহাসে এ মহাযুগান্তকারী মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো। মিরাজের এ অলৌকিক ঘটনা কোনো কালে আর কখনো ঘটেনি।
পবিত্র কুরআনে সুরা বনি ইসরাঈলে মিরাজের ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করিমে ইরশাদ করেন- ‘পবিত্র ও মহিমান্বিত সত্ত্বা ; যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়েছেন। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত পরিমাণ বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাঁকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’ – (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত- ১)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ৫০ বছর বয়সে নবুওয়াতের দশম বর্ষে ২৭ রজব (২৬ দিবাগত) রাতে মক্কার সকলেই এমনকি পশু-পাখিরাও নিদ্রামগ্ন। আর সমগ্র জনপদ নিরব-নিথর। রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই রাতে কাবা শরিফের চত্বরে হাতিমে অথবা কারো মতে উম্মে হানি (রা.)-এর ঘরের এক কামরায় ঘুমিয়েছিলেন। গভীর রাতে আল্লাহপাকের ফেরেশতা হজরত জিবরাঈল (আ.) ও মিকাইল (আ.) সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁদের সাথে ছিলো বিদ্যুতের ন্যায় বোরাক। বোরাক গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়ার চেয়ে ছোট একটি সাধা প্রাণী এবং গতি ছিলো আলোর গতিবেগের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তাঁরা প্রিয় নবী (সা.)-কে কাবা শরিফের হাতিমে নিয়ে এলেন এবং তাঁর বক্ষ মোবারক বিদারণ করে তাঁর পবিত্র কলব্‌কে আবে জমজম দিয়ে ধৌত করে তা পুনসংস্থাপন করলেন। তারপর জিবরাইল (আ.) প্রিয়নবী (সা.)-কে বোরাকে আরোহণ করতে বললেন। বোরাক চোখের পলক ফেলার আগেই জেরুজালেমে মসজিদে আকসায় নিয়ে এলেন। হজরত জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-কে নিয়ে মসজিদে আকসার ভেতরে ঢুকলেন। সেখানে পূর্বে অপেক্ষাকৃত নবী-রাসুলগণের এক বিশাল জামাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই রাকাত নফল নামাজের ইমামতি করেন। তিনি যে সমস্ত নবী-রাসুলগণের ইমাম তা এখানেই প্রমাণিত হয়। নামাজের পর জিবরাইল (আ.) উপস্থিত সবার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেন। নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ এখানেই শেষ। পবিত্র কুরআনের পরিভাষায় বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয়েছে। এখান থেকে তাঁর উর্ধ্বজগত ভ্রমণের পালা শুরু হয়। সাথে ছিলেন হজরত জিবরাইল (আ.)। মুহূর্তের মধ্যে তিনি প্রথম আসমানের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হলেন। প্রথম আসমানের দ্বাররক্ষী ফেরেশতা তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে হজরত জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-এর পরিচয় তুলে ধরলেন। সাথে সাথে আসমানের দরজা উন্মোচিত হয়ে গেলো। ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিপুল অভ্যর্থনা জানালেন। এখান থেকে তিনি মুহূর্তের মধ্যে এলেন দ্বিতীয় আসমানে। এখানেও ওই একইভাবে পরিচয়াদি সম্পন্ন করার পর তাঁকে বিপুল অভ্যর্থনা জানানো হয়। এখানে সাক্ষাত হয় হজরত ঈসা (আ.) ও ইয়াহ্‌য়া (আ.)-এর সঙ্গে। তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে, চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.)-এর সঙ্গে, পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.)-এর সঙ্গে, ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে, সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হয়। তাঁরা সকলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সালাম ও মোবারকবাদ জানান। সপ্তম আকাশে এসে ফেরেশতাদের কাবা বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশতাকে সালামরত অবস্থায় দেখেন। তাঁকে জানানো হলো যে, এখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা সালাত আদায় করেন এবং তাওয়াফ করেন। এই বায়তুল মামুর আকীক পাথর দ্বারা নির্মিত। উল্লেখ্য, ফেরেশতাদের কাবা বায়তুল মামুরের ঠিক বরাবর নিচে পৃথিবীতে বায়তুল্লাহ শরিফ অবস্থিত।
বায়তুল মামুর থেকে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় উপনীত হলেন। সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন হজরত জিবরাইল (আ.)। সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করার ক্ষমতা জিবরাইল (আ.)-এর ছিলো না। তাই তিনি রাসুল (সা.)-কে বললেন- এটাই আমার শেষ সীমানা। এ সীমানা অতিক্রম করলে আমি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবো। এরপর রাসুল (সা.)-কে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ‘রফরফ’ নামক এক বাহন উপস্থিত করা হলো। তারপর তিনি রফরফে চড়ে সত্তর হাজার নুরের পর্দা পাড়ি দিয়ে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিনের আরশে আজিমে উপস্থিত হলেন। তিনি নিকট থেকে নিকটতর হলেন। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি আল্লাহর দুই ধনুক পরিমাণ দূরত্বের কাছে পৌঁছেছিলেন। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিনের দিদার লাভ করলেন। আল্লাহ তায়ালা যা ওহী করার ছিলো তা ওহী করলেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি। তিনি তো তাঁর রবের মহান নিদর্শনসমূহ দেখলেন।’ – (সুরা আন- নাজম : ১৭-১৮)।
মিরাজের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টিজগতের সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য রহস্য সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছেন। আর দেখেছেন আল্লাহপাকের অশেষ নিয়ামত ও কুদরাতের নিদর্শন। আরও অবলোকন করেছেন বেহশত ও দোযখ এবং শাস্তির বিভিন্ন ধরণ ও উপকরণ। এ সময় উম্মতের উপর আল্লাহপাক প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন ; কিন্তু মানুষের পক্ষে কষ্টকর হবে বলে মুসা (আ.)-এর পরামর্শক্রমে এবং আখেরি নবী (সা.)-এর বারবার আবেদনের প্রেক্ষিতে করুণাময় আল্লাহ পঞ্চাশ ওয়াক্তের স্থলে পাঁচ ওয়াক্ত স্থির করে দিলেন। এরপর রাসুল (সা.) আবার বোরাকে আরোহণ করে একই রাতের অন্ধকারে নিমিষের মধ্যে মক্কায় ফিরে আসেন। তখনও তাঁর বিছানা ছিলো উষ্ণ। তিনি যে পানি দিয়ে ওযু করেছিলেন সে পানি গড়িয়ে যাচ্ছিলো। রাসুল (সা.) বলেছেন- কাবা শরিফের দিকে দৃষ্টি দিতে যতটুকু সময় লাগে তার চেয়েও কম সময়ের মধ্যে এই সফর শেষ করে ফিরে এলাম।
রাসুল (সা.) সকালে যখন এ ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করলেন তখন অনেকেই মিরাজকে অবিশ্বাস্য বলে ঠাট্টা-উপহাস করেছে। তবে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মিরাজের কথা শোনামাত্রই কোনোরূপ সন্দেহ-সংশয় ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন করলেন। তাই তিনি মহানবী (সা.) কর্তৃক ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত হন। অতপর মুসলিমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজ গমনকে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন।
প্রকৃতপক্ষে মিরাজের অন্যতম হাদিয়া হচ্ছে নামাজ। রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘আস্‌সালতু মিরাজুল মুমিনিন।’ অর্থাৎ নামাজই মুমিনের জন্য মিরাজ।-(হাদিস) তবে বাস্তবে সেই অসাধারণ নিয়ামতের প্রতি আমরা খুব কমই গুরুত্ব দেই। আমরা অনেকেই নিয়মিত নামাজ আদায় করি না এবং পরিবার-পরিজনকেও নামাজের তাগিদ দেই না। এটা আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীনের নিয়ামতের প্রতি কি অকৃতজ্ঞতা নয়? এ পবিত্র রজনিতে আমাদের শপথ নিতে হবে আমরা এ রজনির উপহার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হবো এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি সর্বাত্নক শ্রদ্ধা নিবেদন করবো।
ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম এ দিবসটি বিশ্বের মুসলিমগণ বিভিন্ন ইবাদতে গভীর ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করেন। আসুন, আমরা আজ এ মিরাজের রাতে বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করে জ্ঞান রাজ্যের সুবিশাল আঙ্গিনাকে উপলব্ধি করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনে নারী
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল