কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট একটি কথা দিয়ে শুরু করতে পারি-‘মাতৃভাষা স্বাধীনতার প্রতীক, আর ভাষা সংস্কৃতির জনক’। আজকের দিনে কথাগুলো খুব যথার্থ বলেই মনে হয়। আমার বলার স্বাধীনতা, দৈশিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এগুলো তো মাতৃভাষাকেন্দ্রিক, ভাষাকে অন্তরে ধারণ করে আমি আমার চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছি, ঠিক তেমনি আমার সংস্কৃতির নিজস্বতাকে ধারণ করি মাতৃভাষার দ্যোতনায়। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি, কিন্তু বাঙালির এই বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে অর্জন করার বিষয়টি সুখকর ছিল না। সংগ্রাম করেই অর্জন করতে হয়েছে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলেও এর সূত্রপাত হয়েছিলো ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ থেকে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় বটে কিন্তু মাতৃভাষা বাংলাকে উচ্চস্থানে আসীন করার বিষয়টি তখন থেকেই ছাত্রজনতার মনে বপন হতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের ৯০ হতে ৯২ শতাংশ মানুষ ছিল বাংলাভাষী আর এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অর্থ বাঙালির বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র যা কখনোই মেনে নেয়া যায়নি।
আমরা বিশ্বাস করি, ভাষাতেই আমাদের স্বাতন্ত্র্য এবং মুক্তি। ভাষাতেই আমাদের দেশপ্রেম আর এই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে গিয়ে আমরা ১৯৫২ তে লড়েছিলাম উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। ১৯৪৮ এ ভাষার যে লড়াই শুরু হয়েছিল ১৯৫২ তে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার পাশাপাশি তার ধারাবাহিকতা আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে ১৯ বছর পার করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পথকে আন্দোলিত করেছে। ভাষাগত আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জনগণের মধ্যে ছাত্রদের একটি বিরাট অংশ দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল। তারাই এগিয়ে ছিল সম্মুখ কাতারে। মাইকেল, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র এরা কেউ ইংরেজি কম জানতেন না। ইংরেজিতে এরা লিখেছেন, কিন্তু বাংলা ভাষাকে এরা স্থান দিয়েছিলেন উঁচুতে। মাইকেল এখানে মুখ্য নন, কিন্তু মাইকেলের চেয়ে অনেক বড় হচ্ছেন মধুসূদন। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি লিখিত হয়েছিল বাংলায় এবং তা ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নোবেল পুরস্কার পায়, বাঙালির অর্জন এখানেই। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত পণ্ডিত, সংস্কৃত কলেজের ছাত্র, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত, সবই ছিলেন তিনি, কিন্তু বাংলাকে সংস্কৃত করে তুলতে চাননি। বাকবিতণ্ডার মধ্যেও তিনি দেশি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন এবং যারা সংস্কৃত শব্দকে ব্যবহার করে বাংলাকে সংস্কৃত করে তুলতে চেয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এখানেই বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য।
মানুষকে মানুষ করেছে ভাষা, বাংলা ভাষা তাই আমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য এবং জাতিসত্তাকে সমৃদ্ধ করেছে নিবিড়ভাবে। ভাষা সংগ্রামের পথ ধরে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ববাংলায় রূপান্তর, ১৯৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে আমরা আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকাকে পেয়েছি, পেয়েছি মাতৃভাষা, বাংলার ইতিহাস পরিণত হয়েছে গর্বিত উত্তরাধিকারে। সম্ভবত আমরাই পৃথিবীর প্রথম জাতি যারা প্রাণ দিয়েছি ভাষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে। আমাদেরতো এ গর্ব থাকা দরকার যে, ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর এক ঘোষণায় জাতিসংঘের ইউনেস্কো আমাদের মাতৃভাষার জন্যে প্রাণবিসর্জনের ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আজকের এই বাংলাদেশ হওয়ার পেছনে দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস বিদ্যমান। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাঙালির নিরন্তর প্রচেষ্টা কখনোই বৃথা যায়নি। ৪৭’ র দেশভাগ পরবর্তী সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিক্রমায় বাঙালি দ্বিধান্বিত ছিল আমাদের জাতিসত্তা নিয়ে। একে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। ১৯৫২ তে হয়েছেও সে আন্দোলন। কারণ মাতৃভাষাতো আমাদের প্রাণের আবেগ, বাংলা আমাদের প্রাণসঞ্চারী অনুভূতি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার হীন চক্রান্তকে যেমন বাংলার জনগণ মেনে নেয়নি, তেমনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপ্নকে সার্থক করার জন্যে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। আমরা হারিয়েছি রফিক, জব্বার, সালাম, শফিউর, বরকতের মতো অকুতোভয় ছাত্রদের। জয় আমাদেরই হয়েছে। আমরাই এই বাংলার সূর্যসেন, প্রীতিলতা, যতীন্দ্রমোহন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে সার্থক করেছি।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভাষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো। ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষার দাবীতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তাতে পাকিস্তান সরকার বুঝতে পেরেছিলো, এ ধরনের একটি প্রাণের দাবীকে দমিয়ে রাখা দরকার। সেই থেকে তাদের প্রচেষ্টা চলেছে। পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা বাংলার জনগণ কখনো মেনে নেয়নি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানান। তাঁর মতে, উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ‘বাঙালিদের গণহত্যার’ সামিল। ১৯৫২ সালে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন ছাত্র জনতার বিক্ষুব্ধ মনোভাবের অবশ্যম্ভাবী একটি জোট বলে গণ্য করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার দিকে ধাবিত হওয়ার যে মূলমন্ত্র নিয়ে ছাত্ররা এগিয়ে গিয়েছিলো তাতে ভাষাগত প্রশ্নে তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের সুর ধ্বনিত হয়েছিলো। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপন ছাত্রজনতার আত্মপ্রত্যয়কে আরো সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যায়।
আমরা যদি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রচিত কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসুনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’র কথা বলি, তাহলে এই রচনায় ভাষার জন্যে কবির হৃদয়মথিত আবেগ আর যে ভালোবাসা, তার জীবন্ত প্রকাশ দেখতে পাই। বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত এ কবিতাটিকে তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, কবিও হুলিয়া মাথায় নিয়ে হয়েছিলেন নিরুদ্দেশ। ইতিহাসখ্যাত এই কবিতাটি হারিয়ে যায়, কিন্তু কোনও এক সময় এটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। একুশের প্রথম গান ‘আমরা ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না‘ আমরা পেয়েছিলাম যে গানটির রচয়িতা ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হক। আমরা এরপর আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং আলতাফ মাহমুদের সুরে অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ভাষা আন্দোলনের গান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি যা এক অমর কীর্তি এবং এখনো তা গীত হয়।
১৯৫২ থেকে ২০২৪ বাহাত্তর বছরের দীর্ঘ এক সময়কাল। এই সময়কালে সংঘটিত হয়েছে আন্দোলন সংগ্রাম এবং যার সর্বশেষ পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু একুশ এখনো আমাদের ধমনীতে বহমান। দেশকে ভালোবাসলে মাতৃভাষাকে ভালো না বাসার কোনও কারণ নেই। কারণ আমাদের জীবনাচরণে বাংলা ভাষাই প্রধান অবলম্বন। আমরা অন্য ভাষা চর্চা করি বটে কিন্তু বাংলা ভাষার কাছে আমাদের ফিরে যেতেই হয়। বাংলা ভাষার প্রতি টান আমাদের নিয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের কাছে, সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যের কাছে, নিয়ে যায় হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি সংস্কৃতির কাছে। তাই ভাষাই আমাদের অহংকার, আমাদের ভালোবাসা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, বাচিকশিল্পী।