ভৌগোলিক অবস্থানে ক্যানাডা ও অ্যামেরিকার নীচে যতগুলো দেশ আছে, সবগুলোরই ভাষা স্প্যানিশ। কারণ এগুলো সবই ছিলো স্পেনের কলোনি। একমাত্র ব্রাজিল ছাড়া। দক্ষিণ অ্যামেরিকার একমাত্র পর্তুগীজ কলোনি ব্রাজিল, এই মহাদেশের অর্ধেক জায়গা জুড়ে রয়েছে। এদেশের জনসংখ্যাও মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী; আর যেহেতু প্রচুর ভূমির অধিকারী, তাই তাদের প্রাকৃতিক সম্পদও অনেক সমৃদ্ধ। ১৯৮৭/৮৮ সালে ব্রাজিলের প্যারানাগুয়া পোর্টে জাহাজ নিয়ে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। এরপরেও, অন্যান্য আরো অনেক জাহাজেই ব্রাজিলের নানান পোর্টে গিয়েছিলাম। আজ ব্রাজিলের অন্যান্য কয়েকটা শহর নিয়ে বলি।
কুরিচিবা
প্যারানাগুয়া শহরটা ব্রাজিলের প্যারানা (Paraná ) স্টেটের মাঝে পড়ে, এবং এই স্টেটের রাজধানী হলো কুরিচিবা (Curitiba ) প্যারানাগুয়া থেকে প্রায় সত্তর মাইল দূরে। ‘ঞ’ অক্ষরটাকে তারা ট এবং চ– এই দুইয়ের মাঝে উচ্চারণ করে, তাই আমিও কুরিচিবা লিখলাম। সেখানে বাসে বা ট্রেনে করে যেতাম। বাসে যাওয়ার পথে খুব সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা ধরতো– অনেকটা আমাদের রাঙামাটির পথ মনে হতো। আর ট্রেনও সেরকম পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যেতো। একজায়গায় উঁচু পাহাড়ের উপরে একটা ব্রিজ আছে, ভীষণ ভয়ঙ্কর। একপাশে দুই–তিন হাজার গভীর খাদ, অন্যদিকে খাড়া পাহাড়। কারা যে এই ব্রিজটা বানিয়েছিলো– সাহসী বটে, বুকের পাটার দরকার! সেখান দিয়ে ট্রেন গেলে এমনিতেই বুকে কাঁপুনি ধরে। একবার একদল কলেজ–পড়ুয়া ছেলেপিলে হৈ–হুল্লোড় করে চলছিলো আমাদের ট্রেনে। তারা এই ব্রিজে উঠার পরে, দাপাদাপি, লাফালাফি শুরু করলো। যুবক বয়সের বাঁদরামি– তারা চাইছে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ট্রেনটাকে ফেলা যায় কিনা দেখবে। আর অন্যদিকে জানালা দিয়ে দেড়–দুই হাজার ফুট খাদ দেখে, আমার তো জান উড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তবে নিশ্চয়ই, তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন, সেটা হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো ছিলা না। কিন্তু ভয় তো যুক্তি মানে না। যা হোক, কুরিচিবা খুবই সুন্দর– অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। চিড়িয়াখানা, পার্ক, মিউজিয়াম, ঐতিহাসিক গির্জা ইত্যাদি। একবার প্যারানাগুয়ায় জাহাজ আসলে, আমরা প্রায় পনের–বিশদিন বা মাসখানেক সেই পোর্টে থাকতাম– মেরিনারদের জন্যে পোর্টে এরকম থাকা মানে, অনেক লম্বা সময়। তাই সময় সুযোগ করে প্রায়ই কুরিচিবা ঘুরতে যেতাম, ছোট্ট শহর প্যারানাগুয়ার একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি পেতে।
রিও–ডি–জেনিরো
ব্রাজিলের বিখ্যাত শহরের মধ্যে একটি, এবং এককালের রাজধানী। পর্তুগীজ ভাষায় জ–এর উচ্চারণ ঐ হয়ে যায়, তাই তারা বলে হিও–ডি–জেনিরো– যার মানে হলো জানুয়ারির নদী। যদিও সেখানে কোনো নদী নাই, কিন্তু পর্তুগীজরা যখন প্রথম এখানে এলো, সেই দিনটি ছিলো ১ জানুয়ারি। তারা উপসাগরকে ভুল করে নদী মনে করে, সেই আবিষ্কারের দিনের সঙ্গে মিলিয়ে শহরের নামকরণ করে। পরবর্তীতে সেটা বিশ্বের একটা বিখ্যাত শহরে পরিণত হয়। আমি দু’তিনবার সেখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু চলাফেরা খুবই সাবধানে করতে হতো। প্রচুর ছিনতাই, রাহাজানি, ভায়োলেন্স হতো সেখানে। সেখানের কোপা–কাবানা বীচ, যীশুর বিশাল মূর্তি (Christ the Redeemer , সুগারলোফ (Sugarloaf ) মাউন্টেন, সুন্দর সুন্দর ঐতিহাসিক গির্জা, পার্ক ইত্যাদি অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কিন্তু আবার বস্তি এলাকা (ভধাবষধ)-ও রয়েছে, এবং সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক ক্রাইম প্রচুর। আমাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হতো, যখন–তখন যেখানে–সেখানে না যেতে, বা একলা চলাফেরা না করতে। সুগারলোফ মাউন্টেন নিয়ে বলি – এইটা শহরের সঙ্গে লাগোয়া একটা ছোট্ট দ্বীপের উপরে পাহাড় – দেখতে অনেকটা বুলেটের ডগার মত। সুগারলোফ মানে কিন্তু মিষ্টি–রুটি না। আগেকার যুগে, আঁখ থেকে তৈরি চিনি তৈরি করে এরকম বুলেটের মত করে বানিয়ে জমাট বাঁধানো হতো। পর্তুগীজরা এখানে উপনিবেশ স্থাপন করে, আঁখ চাষ করে চিনি উৎপন্ন করে নিজদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য এইরকম শেইপ করে বানাত, আর পাহাড়টা দেখতেও সেরকম বলে, তার নাম সুগারলোফ। এর সঙ্গেই আছে আড়াই হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের শীর্ষে, ১০০ ফুট উঁচু পাথরের তৈরি ক্রাইস্ট দা রিডিমার মূর্তি– বিশ্বের একটা ফেমাস ল্যান্ডমার্ক। দুই হাত প্রসারিত করে রিও–ডি–জেনিরো শহরকে সুরক্ষিত রেখেছে, শহরবাসীদেরকে আশীর্বাদ করছে। রিও শহরের অনেক অনেক দর্শনীয় স্থান আছে, আছে ইতিহাস ও গল্প; কিন্তু সেগুলো তো সাধারণ এবং সকলেই দেখবে ও জানবে। তবে এখানে অনন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিলো, যা সারা বিশ্বের ইতিহাসে একবারই হয়েছিলো। পর্তুগিজ শাসকেরা নিজেদের দেশে টিকতে না পেরে পালিয়ে এসে তাদের কলোনি ব্রাজিলের রিও–তে পর্তুগালের রাজধানী বানিয়েছিলো বেশ কয়েক বছরের জন্য। ১৮০৮ সালের দিকে ফ্রান্সের নেপোলিয়ানের ভয়ে তারা দেশ ছেড়ে ব্রাজিলের রিও–ডি–জেনিরোতে পালিয়ে গিয়ে সেখানেই দেশের রাজধানী বানিয়েছিলো। বিশ্ব ইতিহাসে এ–এক বিরল দৃষ্টান্ত।
রিও খুবই প্রসিদ্ধ শহর, এবং আমরা ভুল করে সেটাইকেই রাজধানী মনে করে নেই। আসলে সেই ১৯৬০ থেকেই ব্রাজিলের রাজধানী হলো ব্রাসিলিয়া। এটা বিকেন্দ্রিকরণের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাও–পাওলো, রিও–ডি–জেনিরো ইত্যাদি বড় বড় কসমোপলিটান শহরকে রাজধানী না বানিয়ে, ব্রাসিলিয়াকে বেছে নিয়েছে। বড় শহরগুলো তো এমনিতেই প্রসিদ্ধ, এবং জনসংখ্যাও অধিক। সেগুলোকে বাদ দিয়ে দূরে গিয়ে ব্রাসিলিয়া করায়– ক্ষমতা একবিন্দুতে বা এক শহরে আটকে থাকলো না। আমাদের দেশেও এরকম চিন্তা করা উচিত ছিলো; কিন্তু এর উল্টা হয়ে গেছে– সবই হয়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। জানি না সেটা কি আমাদের জন্য ভালো না খারাপ।
সান্টোস (সাও–পাওলো)
আমি তখন, ‘ইরান ভোজদান’ নামের এক ইরানী জাহাজে ছিলাম। সেই সময়ে খুবই স্বল্প সময়ের জন্যে সান্টোসে গিয়েছিলাম। মনে আছে, মশার প্রচন্ড উপদ্রবে টিকতে পারি নাই। পোর্টে নেমেই কি করবো, না করবো বুঝছিলাম না, এতই মশা। জার্মান এক ভদ্রলোক ছিলো সেই জাহাজের লোকাল এজেন্ট। সে আমাদেরকে দেখে, তার ব্যাগ থেকে গায়ে দেওয়ার মশার এয়ারোসোল স্প্রে আমাদেরকে দিয়ে উদ্ধার করলো। সান্টোস বিখ্যাত তার ফুটবল ক্লাবের জন্য। এই ক্লাবেই ছিলো বিশ্ববিখ্যাত পেলে এবং নেইমার। যা হোক, মশার জন্য আমি বেশিক্ষণ আর ঘুরি নাই। শহরে একটা চক্কর মেরে জাহাজে চলে এসেছিলাম। কিন্তু ব্রাজিলের অন্যান্য বড় শহরগুলোর মতই সান্টোসও বেশ সুন্দর, গোছানো সমুদ্র–সৈকত, পার্ক, ইত্যাদি সব জায়গাই।
আজ শেষ করি ব্রাজিলের নাম কীভাবে হলো সেটা বলে। ১৫০০ সালের পরে পর্তুগীজরা যখন এই দেশ জোর করে দখল করে নেয়, তখন এর অফিসিয়াল নাম দিয়েছিলো Land of Santa Cruz (ev Holy Cross) । কিন্তু নাবিক এবং ব্যবসায়ীরা সাধারণ দৈনন্দিন কথাবার্তায় বলতো pau-Brasil , মানে Land of Brasil ; – সেটা এসেছে ব্রাজিলউড নামের একটা গাছ থেকে। এই গাছের কাঠ বেশ লাল রঙের – ইউরোপে ফার্নিচারের জন্য ভীষণ চাহিদা। শেষে এমনই হলো যে, অফিসিয়াল নাম বদলে কথ্য ভাষার নাম ব্রাজিলই চালু হয়ে গেলো। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি।
refayet@yahoo.com
টলিডো, ওহাইও, ২০২২