মনের ভাব আদান প্রদান করার জন্য সহজ এবং শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। মায়ের ভাষায় কথা বলার মাহার্ত্য এবং আনন্দটাই আলাদা। বাংলাদেশে ৪২ টি ভাষাভাষীর মানুষ থাকলেও প্রায় ৯৯% মানুষ বাংলায় কথা বলে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা, তংচঙ্গ্যা, হাজং, মুরংসহ বেশকিছু নৃগোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। খাড়িয়া ভাষাকে সরকার ২০১৯ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। খাড়িয়া ভাষাটি মূলতঃ পারসি ভাষাভূক্ত একটি ভাষা। এ ভাষাটি সাধারণত চা বাগানে বসবাসর চা শ্রমিকদের মুখেই শোনা যায়। একসময় চা বাগানগুলোতে অসংখ্য খাড়িয়া ভাষাভাষী লোকজন বাস করতো। কালের বিবর্তনে এসব খাড়িয়া চা শ্রমিকের মৃত্যুতে ভাষাটি এখন বিলুপ্তির পথে। পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের চা বাগান সমূহে এমনকিছু চা শ্রমিক রয়েছে যারা নিজস্ব ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে পারে না এমনকী এরা অন্য ভাষা বোঝেও না। তেমন একটি জাতি হচ্ছে খাড়িয়া। আর তাদের ভাষার নাম হচ্ছে খাড়িয়া ভাষা।
এখন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারা বাংলাদেশে মাত্র দু‘জন নারীই অবশিষ্ট রয়েছে যারা বসবাস করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফিনলে টি কোম্পানির অধিনে রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়া বাগানের ৮০ বছর বয়েসী ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়েসী খ্রিস্টিনা কেরকেটা এরা দু‘জন বোন। এরা সবসময় বাড়িতে কিংবা চা বাগানে হরদম খাড়িয়া ভাষায় কথা বলে। বেশকিছু দিন ধরে বোন খ্রিস্টিনা কেরকোটা অসুস্থ থাকায় বড় বোন ভেরোনিকা কেরকোটা খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারছেন না। বোনকে শুধু হাসপাতালে দেখতে যাচ্ছেন কিন্তু নিজেদের ভাষায় তাদের দু‘জনের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন না। ঈশ্বর ছোট বোনকে বাঁচিয়ে তুলবেন ভেরোনিকা কেরকোটা জোর আশাবাদ ব্যক্ত করলেও এমন একটি জীবিত ভাষা চোখের সামনেই তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে দেখে অনেক ভাষাতত্ত্ববিদই হতাশা প্রকাশ করেছেন। মূলতঃ বহুভাষা এবং ভাষা বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে যুগযুগ ধরে নানা ভাষায় কথা বলা বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহ পরম যত্নে তাদের ভাষা সমূহ আগলে রেখেছে বহুকাল ধরে। তেমনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ‘খাড়িয়া‘ জাতিসত্তার বেশকিছু লোক তাদের ভাষাটিকে ধরে রেখেছিল যুগযুগ ধরে। এখন এ ভাষাটি হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে । এ বিষয়ে ‘বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার’ নামের খাড়িয়া ভাষা শিক্ষা সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং চা বাগানের সন্তান পিওস নানোয়ার। যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। যার বসবাস বর্মাছড়া চা বাগান। তিনি বলেন– ‘খাড়িয়া’ “আমি নব্বইয়ের দশকে স্কুলশিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় দাদির কাছ থেকে প্রথম কিছু খাড়িয়া শব্দ শিখেছিলাম। আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে ২০১৭ সালে আমাদের বর্মাছড়া বাগানের উত্তরণ যুব সংঘের মাধ্যমে আমরা ‘বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার’ নামের একটি খাড়িয়া ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র গঠন করি। প্রাথমিকভাবে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মাধ্যমে কিছু শিশুকে খাড়িয়া ভাষা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা চলে।”
পিওস নানোয়ার আরো বলেন, মূলত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চা বাগানগুলোর ৪১টি শ্রমিক কলোনিতে খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর বাস। সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় খাড়িয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা দেশের চা বাগানগুলোর ওই ৪১টি শ্রমিকপাড়া চষে বেড়িয়ে হাজারের মতো খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাই এবং তাদের নাম তালিকাবদ্ধ করি। অনুসন্ধানে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাইনি। খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্রণ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তৎকালীন তরুণ প্রজন্মকে খাড়িয়া ভাষা রক্ষায় ভাষাটি শেখানোর চিন্তাভাবনা করি। কিন্তু দেশে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকায় আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
একই বাগানের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভিনসেন্ট কেরকেটা বলেন, ‘আমাদের দেশের চা বাগানগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। চা বাগানগুলোর অনেকগুলো ভাষা সংরক্ষণ ও পরিচর্চার অভাবে আজ বিপন্ন। খাড়িয়া ভাষায় কথা বলেন মাত্র দুজন। বাকি খাড়িয়া জনগোষ্ঠী সাদ্রিবাংলা, দেশোয়ালী ও খাড়িয়া ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলে। দুই বোনের মৃত্যুর পর প্রকৃত খাড়িয়া ভাষা হারিয়ে যাবে। এটি সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।’
আমরা প্রত্যাশা করবো ভাষা বিজ্ঞানীরা খাড়িয়া ভাষাটিকে খাড়িয়া নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আবার কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এ বিষয়ে গবেষণা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।