হঠাৎ বেড়ে গেছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। দিনে বা রাতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা ওঠানামা করছে। গ্রাহকের চাহিদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চট্টগ্রামে পিডিবির হিসেব অনুযায়ী দুপুরে–সন্ধ্যা ও রাতে যে পরিমাণ লোডশেডিংয়ের কথা বলা হয় বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি। পিডিবির অনেক সাব স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম পাচ্ছেন তারা। হঠাৎ করে কেন এই লোডশেডিং। এর কারণ জানতে গিয়ে মোটা দাগে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমটি হলো, বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি (গ্যাস–কয়লা ও ফার্নেস অয়েল) সংকট; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কার্তিকের তীব্র গরমে কুলিং লোড বেড়ে যাওয়া। প্রতি বছর গ্রীষ্মের পর শরৎ ও হেমন্তের এই সময়ে অর্থাৎ কার্তিক মাসে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে যায়, যা সামাল দিতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়। এবার কার্তিকের এই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে ৩ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কয়লা সংকটে কক্সবাজারের মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১২শ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিটের উৎপাদন গত তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। পুরো নভেম্বর মাস কয়লা সংকটে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। তবে সব প্রক্রিয়া শেষ করে নভেম্বরের শেষ দিকে কয়লা আমদানি করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন) মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন মজুমদার। তিনি আজাদীকে বলেন, ৩১ অক্টোবর থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুটি ইউনিট কমিশনিংয়ের জন্য জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশনের মাধ্যমে কয়লা আনা হয়। চুক্তি অনুযায়ী সুমিতমো কর্পোরেশন কয়লার সর্বশেষ সরবরাহ দেয় আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে। আগস্ট মাসেই জাপানি প্রতিষ্ঠানটির সাথে কয়লা সরবরাহের চুক্তি শেষ হয়। এরপর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিন বছরের কয়লা সরবরাহের জন্য সিপিজিসিবিএল আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়ায় ১০ মাস দেরি হয়ে যায়। দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলে আদালতে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট কয়লা আমদানিতে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয় গত জুলাইয়ে। সেই আদেশটি পরে উচ্চ আদালতে স্থগিত করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। তবে সব প্রক্রিয়া শেষ করে নভেম্বরের শেষ দিকে কয়লা আমদানি করার চেষ্টা চলছে। আশা করছি নভেম্বরের শেষের দিকে কয়লা আমদানি করা গেলে আবার চালু হবে।
বলা জরুরি যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির খুব সামান্য অংশ হলো গ্যাস। চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানাসহ সকল শিল্পকারখানায় এবং আবাসিকের গ্যাসটা আসে এলএনজি থেকে। এছাড়াও তরল জ্বালানি (ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল) এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে। কক্সবাজার মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৬০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে কয়লা সংকটের কারণে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে বিদ্যুতের এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ভারতের আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া পরিশোধ না করায় তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এতে সার্বিকভাবে দেশে বিদ্যুৎ প্রবাহ অনেকটাই কমেছে। অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় কদিন সারা দেশেই কমবেশি লোডশেডিং হচ্ছে। বেশি প্রভাব পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। গ্রামীণ জনপদে এর মধ্যে শীতের আমেজ শুরু হওয়ায় বিদ্যুৎ চাহিদা কিছুটা কমলেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে পোলট্রি–ডেইরিসহ ছোট–বড় কারখানার উৎপাদন এবং কৃষি ক্ষেত্রে। অথচ জ্বালানি–সংকট সমস্যা দ্রুত সমাধানের সম্ভাবনা দেখছে না স্বয়ং বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে আসন্ন শীত মৌসুমে বিদ্যুৎ চাহিদা অনেকটাই কম থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, তখন বেজ পাওয়ার স্টেশনগুলো জাতীয় গ্রিডের লোড সামলাতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎ–জ্বালানি খাতের নাজুক অবস্থার মূল কারণ খুঁজতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি এবং ব্যাপক দুর্নীতি এ খাতের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। রাঘববোয়ালসহ এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে লুটেরামুক্ত করে জাতীয় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুলভ, স্বনির্ভর ও প্রাণপ্রকৃতিবান্ধব মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় নিতে হবে নিজস্ব উদ্যোগ। লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতি দ্রুত রোধ করতে হবে। দেশের মানুষ যেন যৌক্তিক দামে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।