বিদেশে ব্যবসা নিয়ে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন জাবেদ

এক টাকার দুর্নীতি প্রমাণ হলেই পদত্যাগ করব

| রবিবার , ৩ মার্চ, ২০২৪ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশটিআইবি যে তথ্য দিয়েছে, সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন চট্টগ্রাম১৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তবে সেই সম্পদ ও ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো টাকায় করা হয়নি দাবি করে বলেছেন, তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ৫০ বছর আগেই বিদেশে ব্যবসা করেন। তিনি সেই ব্যবসার উত্তরাধিকারী। আর যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময়ও তিনি ব্যবসা করেছেন। যুক্তরাজ্যে তার আয়কর নথিও আছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে যাওয়ার পর ঝুঁকি নিয়ে লাভবান হয়েছেন, এমন একটি কথাও বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা। তার এসব তথ্য যাচাইয়ে নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকদের নিয়ে কমিটি গঠনের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতির প্রমাণ পেলে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন। বিদেশে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়টি সামনে আসার দুই মাসেরও বেশি সময় পর গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সাইফুজ্জামান, যিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসন থেকে টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্য হয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।

সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, আমার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার ৩০ বছরের উপরে, প্রায় ৩৫ বছর হবে। আর আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ১১১২ বছর। আমার বাবার বিদেশের ব্যবসা ৫০ বছরের উপরে। সুতরাং আমার বাবা আমাকে এভাবে ট্রেইনড করে দিয়ে গেছে যে, দেশেও ব্যবসা করতে হবে, বিদেশেও ব্যবসা করতে হবে। শুধু লন্ডনআমেরিকা নয়, যে দেশে সুযোগ আসে, সেই দেশে আমরা বিজনেস করি। এখানে লুকোচুরি করার কিছু নেই।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শেষের নির্বাচনে সাইফুজ্জামানের আসনটি ছিল চট্টগ্রাম১২। ওই বছর সেখানে জেতেন সাইফুজ্জামানের বাবা। ২০১২ সালের নভেম্বরের শুরুতে তিনি মারা গেলে উপনির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয় পান সাইফুজ্জামান। পরের নির্বাচনে আসন পুনর্বিন্যাসে সেটি হয় চট্টগ্রাম১৩। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের শুরুতে নতুন সরকারে ভূমি মন্ত্রী হন তিনি।

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যে সকল কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।

বিদেশে বাবার ব্যবসা ৫০ বছর ধরে : বিদেশে ব্যবসা তার বাবার করে যাওয়া উল্লেখ করে জাবেদ বলেন, আমার ক্যারিয়ারটাই হলো ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার। আমার ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার ৩০ বছরেরও বেশি। আমার বাবার বিদেশের ব্যবসা প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি।

এই ব্যবসার অর্থ বাংলাদেশ থেকে নেওয়া হয়নি জানিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বলেন, বাংলাদেশ থেকে যদি কোনো টাকা নিতাম অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতাম। যদি অনুমতি না নিয়ে বিদেশে টাকা নিতাম তাহলে আমার অপরাধবোধ হতো।

তিনি বলেন, আমি আপনাদের (সংবাদকর্মী) অনুরোধ করব, আমার ব্যবসা এবং রাজনীতি দুটোকে মিঙ করবেন না। আমি ব্যবসায়ীকাম রাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদকাম ব্যবসায়ী নই। পারিবারিক সূত্রেও আমি ব্যবসায়ী। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সন্তান এবং দীর্ঘদিন ধরে আমি ব্যবসা করে আসছি। আমি আমার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার শুরু করেছি আমেরিকায় লেখাপড়া করার শেষ পর্যায়ে এসে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আমেরিকায় পড়াশুনা করেছি আশির দশকে। আমার পড়াশোনা যখন শেষ পর্যায়ে, বিদেশে আমাদের যে পারিবারিক ব্যবসা ছিল, সেখান থেকে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি আন্তর্জাতিক ব্যবসা করার জন্য। যেহেতু আমার বাবা ইংল্যান্ডের সঙ্গে ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন ১৯৬৭এ। ওই সূত্র থেকে আমাদের শুরু। ছোটবেলা থেকেই আমাদের লন্ডনআমেরিকায় বাড়িঘর, ব্যবসাবাণিজ্য ছিল। ওই সূত্র থেকে আমাদের কাজ। আমাদের ট্রেডিং ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, সুপার মার্কেট, রিয়েল এস্টেট এমন অনেক ব্যবসা ছিল। সেখান থেকে আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে।

করোনা মহামারীর সময় ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা বাড়াতে পেরেছেন জানিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, টিআইবির বিষয়টি নিয়ে আমি সারপ্রাইজড। এমন একটি সময় তারা নিউজটি জানাল, ঠিক নির্বাচনের সাত দিন আগে। এটা কি সরকারকে বিব্রত করার জন্য আমাকে দিয়ে? কেন? অনেকে বলছে, আমি মন্ত্রী থাকার সময় আমার ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে। হ্যাঁ, আমি এটা স্বীকার করছি। কেন আমি করেছি? কারণ, করোনার সময় বিশ্ব যখন লকডাউন হয়ে গেল, তখন আমি দেখেছি, আমার জন্য সুযোগ এসেছে। ধাপ ধাপ করে রিয়েল এস্টেটের দাম পড়ে গেছে। ব্যাংক ঋণের সুদ কমে গেছে। আমি রিস্ক নিয়ে সেই সুযোগ নিয়েছি এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছি।

সাইফুজ্জামানের বাবা আখতারুজ্জামান বাবু ছিলেন চট্টগ্রামের একজন নেতৃস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি আরামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

হলফনামায় যে কারণে বিদেশে সম্পদের তথ্য নেই : নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় যে সম্পদের হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে বিদেশে ব্যবসার তথ্য কেন নেই, তারও জবাব দিয়েছেন সাইফুজ্জামান। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন যে হলফনামা করতে হয়, সেটি ট্যাঙ রিটার্নের সঙ্গে মিল রেখে হলফনামা করতে হয়। নির্বাচন হিসেবে আমি সর্বশেষ চতুর্থবার নির্বাচন করেছি। বিগত দিনে আমি যেভাবে আমার হলফনামাগুলো দিয়েছিলাম, এবারও সেভাবে দিয়েছি। ওই হলফনামায় কোথাও উল্লেখ নেই বিদেশের সম্পত্তি উল্লেখ করার জন্য। যেহেতু বিদেশের সম্পত্তি উল্লেখ করার জন্য কোনো কলাম নেই এবং বিগত নির্বাচনেও আমি এই বিষয়ে কোনো তথ্য দেইনি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আমি আমার বিদেশের ব্যবসাবাণিজ্য ও দেশের ব্যবসাবাণিজ্য সেভাবে পুরোটা মিঙ করিনি। কারণ, বাংলাদেশে আমার আলাদা ট্যাঙ রিটার্ন আছে, ইউকেতে আলাদা ট্যাঙ রিটার্ন আছে। ওই ট্যাঙ রিটার্নগুলো আমি মিঙ করিনি। আমি মনে করেছি, যেহেতু এটি হলফনামার কলামে নেই, আমি শুধু শুধু বাড়তি কথা কেন বলতে যাব? সে কারণে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়াই আমি এটা করেছি। এখানে আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।

জবাব এতদিন পরে কেন? : বিদেশে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়ে আলোচনা তৈরি হলেও এতদিন কেন কোনো জবাব দেননি, সেই বিষয়টিও ব্যাখ্যা করেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে আমাকে নিয়ে বেশ কিছু নিউজ হয়েছে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে। অনেকের প্রশ্ন, যখন এই নিউজগুলো এলো, তখন আমি কেন নীরব ছিলাম? আসলে আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশের বাইরে থাকার সময় আমাকে নিয়ে নিউজগুলো এসেছে। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশে এসে আমি একটি সংবাদ সম্মেলন করব। যেহেতু আমি রাজনীতি করি, একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলাম, দায়িত্বে ছিলাম। মন্ত্রী হিসেবে জনগণের কাছে আমার দায়বদ্ধতা আছে, জবাবদিহিতা আছে।

এক টাকার দুর্নীতি প্রমাণ হলেই পদত্যাগ : মন্ত্রী হিসেবে কোনো দুর্নীতি করেননি দাবি করে সাইফুজ্জামান বলেছেন, কেউ এটি প্রমাণ করতে পারলে তিনি সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন। তিনি বলেন, আমি দলকেও বিব্রত করতে চাই না, সরকারকেও বিব্রত করতে চাই না। আমি খুশি হব, আমি মন্ত্রী থাকার সময় কোনো দুর্নীতি করেছি কিনা এই বিষয়ে যদি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করা হয়। এই কমিটিতে একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, একজন সাংবাদিক ও সরকারের ঊর্ধ্বতন একজন প্রতিনিধি দিয়ে যদি কমিটি করা হয় তাহলে আমি খুশি হব। আমি মন্ত্রী থাকার সময় কী করেছি, এটা পরিষ্কার করা হোক। এটা আমার জন্য খুব কমফোর্টের ব্যাপার হবে। এই কমিটি যদি আমার বিরুদ্ধে এক টাকার দুর্নীতি পায়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি আমার পদ থেকে রিজাইন দেব। আমি খুবই পরিষ্কার মানুষ। খুবই সিনসিয়ারলি সততার সঙ্গে কাজ করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই যাত্রীর কাছে পাওয়া গেল ২ কোটি টাকার স্বর্ণ
পরবর্তী নিবন্ধরমজান সামনে রেখে জেলা প্রশাসনের অভিযান শুরু