কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) এবং চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরবিসি) লিমিটেডের সাথে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরোধ দেখা দিয়েছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে নির্ঝঞ্জাটে প্রবেশ করার পথ তৈরির পন্থা বের করতে গিয়ে দেখা দিয়েছে এই বিরোধ। টানেল নির্মাতা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সিডিএর কাছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে। অপরদিকে সিডিএ এই টাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ে বৈঠকের মাধ্যমে এই বিরোধ মীমাংসা করতে হবে বলে সূত্র আভাস দিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, পতেঙ্গা সাগরপাড়কে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। পতেঙ্গা বিচের উন্নয়ন ছাড়াও পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আউটার রিং রোড নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার এই প্রকল্পটির আওতায় পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা বিভাগীয় স্টেডিয়ামের সন্নিকট পর্যন্ত ১৫.২ কিলোমিটারের চার লেনের রাস্তাটির নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে ৯২ শতাংশ শেষ হয়েছে। পতেঙ্গা বিচে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ নানা ধরনের পরিকল্পনাও সিডিএর রয়েছে। যেগুলো ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
অপরদিকে পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলীর তলদেশে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নির্মাণ করছে। প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে। বাকি টাকার যোগান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তহবিল থেকে প্রদান করা হচ্ছে। চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) এবং চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরবিসি) এই টানেল নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যে টানেলটির পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারাগামী অংশের বোরিং সম্পন্ন হয়েছে। আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা আসার দ্বিতীয়াংশের বোরিং কার্যক্রম চলছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই টানেল দিয়ে ঘণ্টায় আশি কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলাচলের কথা রয়েছে।
পতেঙ্গায় টানেলের সাথে সিডিএর আউটার রিং রোড যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। যাতে ফৌজদারহাট থেকে একটি গাড়ি ইচ্ছে করলে রিং রোড ধরে এসে টানেলে প্রবেশ করতে পারে। অপরদিকে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি গাড়ি যাতে টানেল থেকে বের হয়েই নগরীতে প্রবেশ না করে ফৌজদারহাট হয়ে ঢাকা কিংবা অন্যান্য দিকে যাতায়াত করতে পারে সেজন্য বিশেষ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। টানেলের মুখ থেকে একটি রাস্তা পতেঙ্গা বিচের পাশ দিয়ে রিং রোডে গিয়ে যুক্ত হবে। এতে করে পতেঙ্গা বিচ এলাকায় একটি ক্রসিং তৈরি হচ্ছে। এই ক্রসিং যদি স্বাভাবিকভাবে করা হয় তাহলে টানেল কিংবা রিং রোডের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে। পতেঙ্গা সি বিচে হাজার হাজার মানুষ এবং অসংখ্য গাড়ির আনাগোনা ওই ক্রসিং এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি করবে। বিষয়টি মাথায় রেখে ওই ক্রসিংটিতে টানেল-রিং রোড অ্যাপ্রোচ রোড উপর দিয়ে নিয়ে নিচে একটি বক্স কালভার্ট তৈরি করে বিচের গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করা হচ্ছে। এতে রিং রোড এবং বিচের গাড়ি চলাচল নির্ঝঞ্জাট থাকবে। কোনো গাড়ি রাস্তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। বিষয়টি মাথায় রেখে টানেল কর্তৃপক্ষ বিশ ফুটের একটি বক্স কালভার্ট করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সিডিএর পক্ষ থেকে বলা হয়, যে পরিমাণ মানুষ পতেঙ্গা বিচে চলাচল করবে ২০ ফুট রাস্তা কিংবা বক্স কালভার্ট তা সামাল দিতে পারবে না। সিডিএর পক্ষ থেকে এই রাস্তাটিকে কমপক্ষে ৪০ ফুট থেকে ৬০ ফুট করার প্রস্তাব করা হয়।
সিডিএর একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, টানেল থেকে আসা রোড রিং রোডে যুক্ত হয়ে উপর দিয়ে চলে যাবে। চার লেনের এই সড়কে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা ব্যারিয়ার তৈরির সুযোগ নেই। এই রাস্তার নিচ দিয়ে একটি বক্স থাকবে। যাতে কাঠগড় থেকে যাওয়া বিচ মুখী রাস্তাটি বিচে চলে যাবে। কালভার্টের নিচ দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে। কিন্তু মাত্র ২০ ফুট একটি বক্স এই মানুষ এবং গাড়ি চলাচলের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই কমপক্ষে দুইটি বক্স করার প্রস্তাব করেছি আমরা। ২০ ফুটের একটি বক্স দিয়ে গাড়ি যাবে, অপর বক্স দিয়ে গাড়ি আসবে। এর বাইরে ফুটপাত থাকবে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী জানান, টানেলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এই বাড়তি কাজ করতে রাজি হচ্ছে না। তারা বলছে, এটি তাদের কন্ট্রাক্টে নেই। তাই এই কাজ তারা করতে পারবে না। সিডিএ নিজেদের ব্যবস্থাপনায় রিং রোড প্রকল্পের আওতায় কাজটি করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু চায়নিজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তাদের এলাকার ভেতরে সিডিএ বা অন্য কোনো সংস্থাকে প্রবেশ করতে দিতে রাজি হচ্ছে না। তারা নিজেরাই বক্সটি করে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বলেছে, বক্স কালভার্টটির নির্মাণ ব্যয় তাদের প্রদান করা হলে তারা সেটি তৈরি করে দেবে। এই খাতে অন্তত সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হবে। একটি বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে এভাবে নগদে টাকা দেয়ার কোনো সিস্টেম সিডিএর নেই। এই অবস্থায় বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে টাকা প্রদান করতে সিডিএ অস্বীকৃতি জানায়। ফলে পতেঙ্গা বিচ এলাকায় প্রবেশের পথ নির্মাণ কোন পথে যাচ্ছে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সাথে জড়িত শীর্ষ একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টিকে বিরোধ বলা ঠিক হবে না। টানেলের আওতায় চাইনিজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কী কী কাজ করবে তার একটি চুক্তি আছে। চুক্তির বাইরে কোনো কাজ তাদের করার কথা নয়, করবেও না। এখন বাড়তি কোনো কাজ করাতে হলে তার খরচতো দিতে হবে। সিডিএ যদি সরাসরি টাকা দিতে না পারে সেক্ষেত্রে সরকারি তহবিল হয়ে টাকাটা আসতে পারে। কারণ এই প্রকল্পেতো সরকারের তহবিল থেকে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি টাকা আসবে।
এই ব্যাপারে সিডিএর পদস্থ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০ ফুট বক্স দিয়ে পতেঙ্গা বিচে গাড়ি চলাচল ঠিকঠাকভাবে হবে না। তাই ৪০ ফুট বক্স এবং উভয়পাশে ২০ ফুট ফুটপাত করানোর প্রস্তাব দিয়েছে সিডিএ। বাড়তি টাকা সিডিএ দেবে। কিন্তু দেয়ার সিস্টেম অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সিডিএ বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা প্রদান না করে তা সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রদান করবে। সেতু কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ বুঝে নিয়ে টাকা প্রদান করবে। তবে এক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ছাড়া সম্ভব নয়। বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সিডিএর এই বিরোধ মীমাংসায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক আহ্বান করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এই ব্যাপারে সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একটু সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমরা আলাপ আলোচনা করছি। বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সুরাহার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, টানেলও আমাদের জন্য, পতেঙ্গা বিচও আমাদের জন্য। সুতরাং কোনো সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই তা সুরাহা করে নিতে হবে।