“হুজুরেরা আজকাল বিনা কাজে নাম চায়
তাই দেশ ভরে গেছে চাটুকার চামচায়।”
আমাদের অনেক নেতা–কর্তা আছেন, যাঁরা কাজ না করে কেবল নাম চান। প্রত্যাশা করেন সবাই যেন তাঁর সুনাম করেন, বাহ্বা দেন। কিন্তু আজ আমি তাঁর কথা বলবো, যাঁর প্রশংসা না করে পারছি না। বেশ কয়েকটি কারণে তাঁর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়। কেননা একটার পর একটা প্রশংসনীয় কাজ করে তিনি তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন, মোহিত করছেন আমাদের। তিনি হলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
তিনি চলমান চট্টগ্রামকে বদলে দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পর অভাবনীয় সব কাজ করে অভিভূত করছেন আমাদের। ‘খেলার মাঠে মেলা নয়’ ঘোষণা দিয়ে বসে থাকেন নি, বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর আউটার স্টেডিয়ামসহ খেলার মাঠগুলোতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আর কোনো মেলা হবে না। এগুলো খেলাধুলার জন্যই উন্মুক্ত রাখা হবে। মাঠে অবৈধ স্থাপনা থাকলে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে। তবে অন্য খোলা মাঠে মেলার আয়োজন বন্ধ থাকবে না।’
দীর্ঘদিনের বেদখলে থাকা খেলার মাঠ রক্ষায় নিয়েছেন তিনি কঠোর পদক্ষেপ। খেলার মাঠ থেকে তাড়িয়েছেন সব ধরনের মেলা। গুঁড়িয়ে দিয়েছেন খেলার মাঠের আশপাশের সব অবৈধ স্থাপনা। এছাড়া অনেকের হম্বিতম্বি ও রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উদ্ধার করেছেন বেদখল হওয়া সরকারি শতকোটি টাকার সম্পদ। জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েই ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান যে কাজগুলো করে চলেছেন, তা এককথায় অভিনন্দনযোগ্য। নগরের কাজীর দেউড়ি– সার্কিট হাউজ সংলগ্ন শিশু পার্কটি সিলগালা করে জমির মালিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সমগ্র টিম অত্যন্ত সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
সবশেষে আমাদের শিল্প–সাহিত্যের মানুষগুলোকে মুগ্ধ করেছেন ‘বিজয় নিশান’ নামের একটি অপূর্ব সংকলন উপহার দিয়ে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত এ সংকলনে চট্টগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা প্রসঙ্গ সংকলনে স্থান পেয়েছে। এ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক সৃষ্টি করলেন আরেক নতুন ইতিহাস। প্রকাশনা উপলক্ষ্যে ২৯ এপ্রিল বিকেলে সংকলনের লেখকদের নিয়ে জেলা প্রশাসক ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ও চা চক্রে মিলিত হন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কবি মালেক মুস্তাকিমের সূচনা বক্তব্য শেষে লেখকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘বিজয় নিশান’ সংকলনটি। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য ড. মো. সেকান্দার চৌধুরী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোহীত উল আলম, প্রাবন্ধিক প্রফেসর রীতা দত্ত, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, বেতার ব্যক্তিত্ব–শহীদ পরিবারের সন্তান ফজল হোসেন, কবি নাট্যজন শিশির দত্ত, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক কানাই দাশ, কবি কামরুল হাসান বাদল, ছড়াসাহিত্যিক অধ্যাপক আলেক্স আলীম, প্রাবন্ধিক ড. শামসুদ্দিন শিশির, কথাসাহিত্যিক ড. আজাদ বুলবুল, নাট্যজন সাইফুল আলম বাবু, সাংবাদিক অনুপম শীলসহ আরো অনেকে। তাঁরা বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন। আমি নিজেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমার মতামত তুলে ধরেছি। আরো যাঁদের উপস্থিতি এ বৈঠককে সমৃদ্ধ করেছে, তাঁরা হলেন বিজিএমইএ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মুহাম্মদ শামসুল হক, চিত্রশিল্পী দীপক দত্ত, প্রাবন্ধিক ড. আহমেদ মাওলা, ড. শ্যামল কান্তি দত্ত, সাংবাদিক সুভাষ দে, নাট্যজন ড. ইউসুফ ইকবাল, কবি আহমেদ মুনীর, লেখক শামসুল আরেফীন, কবি শাহীন মাহমুদ, গল্পকার রুনা তাসমিনা, নাট্যজন জাহেদুল আলম, কবি রিমঝিম আহমেদ প্রমুখ।
জেলা প্রশাসক ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সবার বক্তব্য শোনেন এবং বলেন, জেলা প্রশাসন আপনাদের সকল শুভ কাজে পাশে থাকবে। তিনি এসময় তাঁর আগামী পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, ডিসি পার্কে আয়োজিত ‘ফুল উৎসব’ সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম জানিয়ে দিয়েছে যে ওখানে ভালো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সাফল্য আসবে। তিনি ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন। বললেন, বাছাই করা কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজনের অনুমতি দেওয়া যায় কিনা আমরা ভাবছি। চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় একটি সাহিত্য উৎসব করার জন্য তিনি সকলের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়, হাসনাত আবদুল হাই যখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন, তখন এখানে সপ্তাহব্যাপী একটি সাহিত্য–সংস্কৃতি উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় মনীষী অধ্যাপক আবুল ফজলকে। এবারো ডিসেম্বরকে টার্গেট করে একটা উৎসবের আয়োজনে জেলা প্রশাসক সকলের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
আমাদের বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ঠিক করা হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ। এগুলো হলো–স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। এ চারটি স্তম্ভের আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে কানেক্টিভিটি (অবকাঠামো উন্নয়ন), মানব সম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, ফ্রিল্যান্সারদের উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ এবং ইভেন্ট ও প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
এমন অবস্থায় ‘স্মার্ট চট্টগ্রাম’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা অসামান্য। জানা গেছে, সরকারের উদ্যোগের আওতায় চট্টগ্রামকে প্রথম স্মার্ট জেলা করতে কাজ করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এর অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে গত কয়েক মাসে একাধিক বৈঠক করে জেলা প্রশাসন। যেখানে লালখান বাজার, জামালখান ও বগমনিরামকে স্মার্ট ওয়ার্ডে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।
বলা বাহুল্য, এই চট্টগ্রাম বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণসহ নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যায় জর্জরিত। মাঠের সংখ্যা কমছে। পার্ক নেই। দিন দিন বিলীন হচ্ছে সবুজ। জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হচ্ছে প্রতিনিয়িত। মশার উৎপাত দিনরাত। ফুটপাতের পরিসর সীমিত হচ্ছে। যানজটে পড়ে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যত্রতত্র ময়লা–আবর্জনা। রয়েছে অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। তবু মানুষ শহরে বাস করছে, শহরে আসছে। কেননা, ভালো চিকিৎসা, ভালো শিক্ষা, কর্মসংস্থান এখনো শহরকেন্দ্রিক। জলাবদ্ধতা, সবুজ কমে যাওয়া, যানজট, বায়ুদূষণ, ডেঙ্গুতে মৃত্যু–এগুলো সাধারণ ও পুরোনো সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে। শহরকে স্মার্ট নগরীতে পরিণত করতে দরকার কার্যকর ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। সেই আলোকে এবং অর্পিত দায়িত্ব মাথায় নিয়ে নিরন্তর ছুটে চলেছেন জেলা প্রশাসক।
বলা যায়, বেশ কিছু নতুন ও ব্যতিক্রমী কাজ উপহার দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। পর্যটক বাস চালু করেছেন নগরে, চালু করেছেন স্মার্ট স্কুল বাস। আনন্দের বিষয়, স্মার্ট জেলা উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জ–২০২৩ এর প্রথম পুরস্কার পেয়েছে স্মার্ট স্কুল বাস। টাকার অংকে পুরস্কারের পরিমাণ ৮০ লাখ টাকা। আশা করছি, স্মার্ট স্কুল বাসের কারণে নগরীর বিভিন্ন স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে অসহনীয় যানজট, অভিভাবকদের ভোগান্তি, অধিক যাতায়াত খরচ, জ্বালানি অপচয়, অনিরাপদ স্কুল যাত্রাসহ অভিভাবকদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার মতো সমস্যার সমাধান হবে।
আসলে জেলা প্রশাসক ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের প্রতিটি কাজ ও পরিকল্পনা তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল। এসব কর্মের মধ্য দিয়ে মেধাবী, চৌকস, সাহসী ও মানবিক জেলা প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তিনি। চট্টগ্রাম অন্তপ্রাণ এই মানুষটির এমন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক– সেই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো (নম্বর –৪২২), বাংলা একাডেমি।