ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত চট্টগ্রাম। প্রতিদিনই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সমাবেশ, মানববন্ধন ও মিছিল চলছে। গতকাল শনিবার বিকেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল রহমতগঞ্জে ভেঙে দেওয়া ঐতিহাসিক বাড়িটি পরিদর্শনে যান। এ সময় দখল বুঝে নেওয়ার নামে হঠাৎ করে বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনবেন বলে জানান উপমন্ত্রী।
এদিকে অপর এক সমাবেশে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়িটিকে জাদুঘর করার বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা দিতে সরকারকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। এর মধ্যে ঘোষণা না এলে ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি পালনের হুমকি দেন তিনি। গতকাল উপমন্ত্রী বাড়িটির ভেতরে গেলে তাকে দেখে এগিয়ে যান এম ফরিদ চৌধুরী (দখলদার)। উপমন্ত্রী বাড়ি ভাঙার কারণ জানতে চাইলে ফরিদ চৌধুরী বলেন, আমরা আদালত থেকে রায় পেয়েছি। আদালত ভেঙেছে, আমরা ভাঙিনি।
জবাবে উপমন্ত্রী বলেন, রায় যেটাই পান, বাড়ি ভাঙার তো অধিকার নেই। রায় দেওয়ার পর আদালত পজিশন বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু ভেঙে তো বুঝিয়ে দেয় না। এই বাড়িটার ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এটা পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত হওয়ার মত ভবন। এটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হল কেন? এটা খুবই অন্যায় কাজ হয়েছে। মনে হচ্ছে এখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। রায়টা কতটুকু, কি হয়েছে-সেটা বিবেচনা করতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে, রায়ের ভিত্তিটা কী সেটা দেখতে হবে। কিন্তু পজিশনে কে থাকবে অথবা থাকবে না সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই আদালত দেবেন।
তিনি বলেন, হঠাৎ করে একটি ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে দেওয়া একেবারে গর্হিত কাজ হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এটা বেআইনি। এই স্থাপনার হেরিটেজ হিসেবে একটা মূল্য আছে, সেটাকে সম্মান দেখানো উচিত ছিল। সেটা ভেঙে দেওয়ার পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে-জেলা প্রশাসনকে পক্ষভুক্ত না করেই এটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অর্পিত সম্পত্তি কীভাবে ব্যক্তি মালিকানায় গেল সেটাও তদন্ত করে দেখতে হবে।
জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে নওফেল বলেন, একজন নাজির এসে নাকি জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কাগজপত্রে যা দেখেছি, উনার তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল না। তবে তারা বলছেন যে, আদালতের রায়ের বিষয়। সেখানে আদালতের রায়টা কী, সেটা আমাকে দেখতে হবে। অর্পিত সম্পত্তির কেয়ারটেকার জেলা প্রশাসন, তাদের না জানিয়ে কীভাবে জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, সেই বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনের দেখা দরকার ছিল।
ভবনটিতে গড়ে তোলা ‘শিশুবাগ স্কুল’ জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, একটা স্কুলের যখন অনুমতি থাকে, তখন পাঠদানের অনুমতি থাকে, একাডেমিক অনুমোদন থাকে-এতগুলো সরকারি স্বীকৃতি থাকার পরও কীভাবে হঠাৎ করে সেটাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। আবার উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসন অবগত ছিল না, সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে এখানে অনেক ষড়যন্ত্রমূলক কাজ হয়েছে।
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক বাড়িটি জাদুঘর করার দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে অবশ্যই আমি ভূমিকা রাখব। জে এম সেন হলের অনেক অনুষ্ঠানে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অংশ নিয়েছেন। তিনি আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও এখানে প্রোগ্রাম করেছিলেন। সুতরাং উনি অনেক আগে থেকেই অবগত আছেন যে, জে এম সেনের বাড়ির ঐতিহাসিক মূল্য আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি বিষয়টি উনার দৃষ্টিগোচর করব। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও দৃষ্টিগোচর করব। জাদুঘর করার বিষয়ে সেখান থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে সকালে রহমতগঞ্জে দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ির সামনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম আয়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। বাড়িটি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারি সুষ্পষ্ট সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা চাই। না হলে ১৮ জানুয়ারির পর এই বাড়ির সামনে আমরা আমরণ অনশনে বসব। আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে কিছু দখলবাজ ছাড়া চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নাগরিকরা আছেন। এরপরও বলছি, কে পাশে থাকবে আর কে থাকবে না সেটি বিবেচনা করব না। কেউ পাশে না থাকলেও আমি একাই আমৃত্যু অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাব।