দারিদ্রের কারণে স্বামীর দেয়া সবচেয়ে বড়ো সম্পদ, নাকের নোলক বিক্রি করে সন্তানের পরীক্ষার ফি যোগাড় করেছেন এমন মায়ের নজির এই বাংলাদেশে অগণিত খুঁজে পাওয়া যাবে। ডাক্তারের কাছে গেলে একগাদা ঔষধ আর টেস্ট করাতে দেবে। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাবে এই ভয়ে শরীরে রোগ পুষে রেখে জীর্ণ শীর্ণ মলিন কাপড় গায়ে যে মানুষটি সংসারের বোঝা হাসিমুখে টেনে যাচ্ছেন, সন্তানদের প্রতিটি চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন, দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে হাড়ভাঙা খাঁটুনি খেটে ক্লান্ত যে মানুষটি সংসার এবং সন্তানদের জন্য নিজের পুরো জীবন কোরবানি করে দিচ্ছেন এমন বাবাও এই দেশের আনাচে কানাচে অগণিত খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি সন্দিহান কয়জন সন্তান এমন আছে, যে তার বাবা–মায়ের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দেবে! কিছু ব্যতিক্রম হয়তো আছে। আমার জানা নেই। অনেকে হয়তো বলবেন, ‘আমি তো আমার বাবা–মাকে কোনো কিছুর অভাবে রাখিনি! যা কিছু দরকার, তারচেয়েও অনেক বেশি কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছি।‘
যারা এভাবে ভাবছেন, শুধু তাদের উদ্দেশ্যে আজ কিছু কথা বলবো। যে মা নোলক বিক্রি করে সন্তানের পরীক্ষার ফি যোগাড় করেছেন, সেই সন্তান বড় হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যদি তার মায়ের পায়ের কাছে দুনিয়ার সব টাকা এনে লুটিয়েও দেয়, তবুও তার মূল্যমান ওই নোলক বিক্রি করা টাকার চেয়ে অনেক কম হবে। কারণ, ওই মায়ের কাছে নোলক বিক্রি করা টাকাগুলো শুধু কিছু মুদ্রা ছিলো না। ওগুলো ছিলো নোলক বিক্রি করা কিছু স্বপ্ন। যার মূল্য দেবার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো ধনীর নেই। যে বাবা রোগ পুষে, হাড়ভাঙা খাঁটুনি খেটে ঘামের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন, সে জীবনকে টাকা দিয়ে মাপার মতো পাল্লা এখনো তৈরি হয়নি। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, তাহলে বাবা–মায়ের জন্য আমরা কী করতে পারি?
আসলে বাবা–মায়ের জন্য কী করা উচিত বা কী করা কর্তব্য সেটা নিয়ে কিছু লেখার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। এটা অনেকটা যার যার অনুভবের বিষয়। শিক্ষা, আদর্শ, রুচি ও মূল্যবোধের বিষয়। আমি শুধু আমার একান্ত নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আমার উপলব্ধিতে মায়ের নোলক বিক্রি করা স্বপ্নের মূল্য কখনো চুল পরিমাণও শোধ করা যাবে না একথা সত্য। বাবার ঘামের একটা ফোঁটার মূল্য কখনো শোধ করা যাবে না একথাও সত্য। কিন্তু মা–বাবার আত্মাকে তৃপ্ত করা যাবে। তাদের মনে হবে, ‘হ্যাঁ, আমার সন্তান আমাকে ভালোবাসে।‘
মা–বাবার এই উপলব্ধিটাই আসল। সেক্ষেত্রে আমার কেন জানি মনে হয়, হয়তো আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। হয়তো আমিও। আমার আপনার মতো অনেকেই বড্ড দেরি করে ফেলেছি হয়তো।
আচ্ছা বলুন তো, কোন উপলক্ষ ছাড়া শেষ কখন আপনি আপনার মা‘কে অথবা বাবা‘কে জড়িয়ে ধরেছিলেন মনে পড়ে? মোবাইলটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে আপনার বাবা–মা‘র সাথে শেষ কবে তাদের গল্পের সাথী হয়েছেন, মনে পড়ে?
আপনার ব্যস্ত সিডিউলে সবার জন্য আপনার সময় আছে। শুধু আপনার বৃদ্ধ বাবা–মা‘র জন্য কোনো সময় নেই। অথচ, বৃদ্ধ বয়সের এই সময়টাতে তাঁরা খুব একাকীত্বে ভোগেন। তাই তাঁরা একটু কথা বলার সঙ্গী চান। আপনার মায়ের অথবা বাবার হয়তো কোনো অভাব রাখেননি আপনি। কিন্তু তাঁরা আপনার ভালোবাসার অভাব, আপনার সান্নিধ্যের অভাব বোধ করছেন না তো? অনেকের ভাগ্যে মা–বাবা দু‘জনকে একসঙ্গে নিজের সফলতা দেখানো সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে মা কিংবা বাবার প্রতি আপনি কতটুকু খেয়াল রাখেন? তিনি নিঃসঙ্গতা নিয়ে বিষণ্ন জীবন কাটাচ্ছেন না তো?
শেষ কখন, আপনি অফিস থেকে ফেরার পথে আপনার মায়ের জন্য একটা শাড়ি অথবা বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছেন মনে পড়ে? আপনি হয়তো কোনো একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই আপনার মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে নিয়ে গেলেন। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আপনার মা বলবে, ‘কেন শুধু শুধু টাকা অপচয় করতে গেলি বাবা! আমার তো অনেক শাড়ি আলমারিতে এখনো নতুন পড়ে আছে।‘
আপনি নিশ্চিত থাকুন, আনন্দের আতিশয্যে আপনার মা গোপনে অথবা আপনার সামনেই চোখের পানি মুছবেন। এই চোখের পানি বড় বেশি আনন্দের, গর্বের ও পরিতৃপ্তির। বাবা–মা‘র চোখ থেকে আনন্দে ঝরে পড়া প্রতি ফোঁটা চোখের পানির দাম সৃষ্টিকর্তার কাছে হয়তো আপনার সারাজীবনের তপস্যার চেয়েও অনেক বেশি।
এটাও নিশ্চিত থাকুন, আপনার মায়ের জন্য কেনা সেই শাড়িতে আপনার মা সবার নজর এড়িয়ে চুপিচুপি হাত বোলাবেন। মায়ের প্রতি সন্তানের টান উপলব্ধি করবেন। আপনার বাবা হয়তো গর্ব ভরে তার বন্ধুর সাথে গল্প করবেন…
‘জানিস, ছেলেটাকে নিয়ে আর পারি না! কথা নেই বার্তা নেই আমার জন্য অনেক দামী একটা পাঞ্জাবি নিয়ে হাজির। বলে কিনা, আমার জন্য অনেকদিন কিছু কেনা হয়নি। কাণ্ড দেখ্, আমার পাগল ছেলের!’
বিশ্বাস করুন, এই কথাগুলো বলার সময় আবেগে আপনার বাবার গলা ধরে আসবে। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসবে। চোখের কোণাটা ভিজে উঠবে। আর উনার বুকের ছাতি বড় হতে হতে আকাশের সীমা ছাড়িয়ে যাবে।
আসলে বাবা–মাকে খুশি করার জন্য কখনোই টাকার দরকার হয় না। শুধু টাকা দিয়ে বাবা–মাকে খুশি করা যায় এই ধারণাটাই মাথা থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলুন। আপনি শুধু তাঁদেরকে এটি অনুভব করতে দিন যে, আপনি তাঁদের পাশে আছেন। তাঁদের আপনি ভীষণ যত্ন করেন। আপনার বাবা–মা আপনার কাছ থেকে টাকা চান না কখনো। তাঁরা শুধু ‘যত্ন‘ চান। প্রাসঙ্গিক ভাবে একটা কথা বলতে চাই, আমার বাবা মারা গেছেন একুশ বছর আগে। এই একুশ বছরে এমন হাজারো মুহূর্ত আছে, যখন আমার চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করেছে ‘বাবা‘! প্রচণ্ড আবেগে ছুটে গিয়ে বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেছে। আকুল হয়ে বলতে ইচ্ছে করেছে ‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা।‘ সেসব আবেগ উচ্ছ্বাসের বাইরে বাবা আছেন কোনো এক ঠিকানাহীন সীমানায়।
আফসোস! বাবা জেনে গেলেন না, তাঁর ছেলেটা তাঁকে কী প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো, বাবার জন্য একটা দামী মোবাইল সেট কিনবো। একুশ বছর আগে দামী মোবাইল সেট কিনবার মতো টাকা আমার ছিলো না। ভেবেছিলাম কিছু টাকা জমিয়ে তারপর কিনবো। কিন্তু বিধাতা আমাকে অতখানি সময় দিলেন না। বাবা চলে গেলেন। মার্কেটের দামী সেট এখন আমাকে আর আকৃষ্ট করে না। যাঁর হাতে দেখতে চেয়েছি সেই মানুষটির সঙ্গে কথা কথা বলার কোনো মাধ্যম এখনো বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। অনেকের মতো আমিও আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
আপনার জীবনে হয়তো এমন একটা সময় আসবে, যখন আপনার গাড়ি থাকবে, বাড়ি থাকবে, পকেট ভর্তি টাকা থাকবে, দুনিয়ার সবচেয়ে দামী জিনিসটা কিনবার ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু বাবার জন্য, মা‘য়ের জন্য কিছু কিনবার ভাগ্য থাকবে না। নিজের জীবনের সমস্ত অর্জনকে মুহূর্তেই নাই মনে হবে তখন। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আপনার অবশ্যই মনে হবে, মাথার উপর ‘বাবা–মা‘ নামের কারো ছায়া থাকাটা খুব বেশি দরকার ছিলো।
যারা বাবা–মা‘কে ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছেন, দোয়া করা ছাড়া তাদের তো আর কিছু করার নাই। তারা হতভাগা। কিন্তু যারা ভাগ্যবান, যাদের বাবা–মা এখনো জীবিত, তাদের জন্য বলা…
পৃথিবীতে মহান সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো বাবা–মা। তাঁদের সেবা করুন। যত্ন নিন। ‘দে আর জাস্ট ব্লেসিংস অব অলমাইটি।‘ তাই বেঁচে থাকতেই তাদের কদর করুন। অন্যথায়, অনেক দেরি হয়ে যাবে।
প্রকৃতির নিয়ম কি জানেন? সে কিন্তু ফিরিয়ে দেয়। প্রকৃতি কোনো ঋণ রাখে না। আপনি নিজেও প্রকৃতির একটি অনুষঙ্গ। সুতরাং ‘সময়‘ যেন আপনাকে বোবা বানিয়ে না দেয় সেই কাজটি করুন। মা আর বাবা দুজন মানুষকে চিনুন। জানুন। ভালোবাসুন। যত্ন নিন। এটি অনেক কঠিন কাজ। তবুও মনোযোগ দিয়ে সেই কাজটি করুন। হয়তো তাঁরা আমার, আপনার মতো শিক্ষিত নন। হয়তো তাঁরা আমার, আপনার মতো আধুনিক নন। হয়তো তাঁরা আমার, আপনার মতো ‘স্ট্যাটাস‘ বোঝে না। তবুও তাঁদের নিজস্বতা কেড়ে নিবেন না। থাকুক না তাঁরা তাঁদের মতো। বরং আপনিই এগিয়ে যান।
লেখক: কবি ও মটিভেশনাল স্পিকার।