আমার বাবা আর দশটা বাবার মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন। কঠিন চেহারা। শক্ত চোয়াল। অত সহজে হাসতেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হতো মেপে। ভুলচুক হলেই বকা খাওয়ার ভয়। তিনি হলেন বাবা। চারপাশে দেয়াল তুলে রাখা এই বাবাকে আমরা নির্ণয় করতাম বাইরে তিনি যত কঠিন, ভেতরে ততটাই কোমল। বাবারা এমনই হয়!
আমার বাবার একজনের আয়েই পুরো সংসার চলতো। পরিবারের সব ভাইবোনকে শিক্ষা দীক্ষায় মানুষ করতে বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বাবা বটবৃক্ষ, নিদাঘ সূর্যের তলে সন্তানের অমল–শীতল ছায়া। জীবনের অনেক সময় বিদেশে ছিলেন বাবা। প্রবাসে থেকে সার্বক্ষণিক খবর রাখতেন। আমার মাও ছিলেন সচেতন। বাবা পরিবারের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া, চারিত্রিক সৌন্দর্যতা, আচরণ, ব্যবহার সব বিষয়ে তাগাদা দিতেন চিঠি লিখে। বাবার তুলনা তিনি নিজেই। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ আর নিঃসীম নিরাপত্তার চাদর।
বাবা। অসাধারণ এক লালন, পালনকর্তা এবং প্রয়োজনের নীরব যোগানদাতা। এক শীতল ছায়াদায়ী বৃক্ষ। বৃক্ষ যেমন ছায়া দেয়, ফল দেয়, জ্বালানী দেয়, কাঠ দেয়, দেয় বাঁচার জন্য অঙিজেন দেয় তেমনি বাবাও দেন ছায়া, দেন প্রয়োজনের ফল–জ্বালানী–কাঠের যোগান। দেন সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার, আত্মপরিচয়ের অক্সিজেন।
বর্তমান সন্তানেরা বাবাদের সাথে যে আনন্দঘন সময় কাটাতে পারে আমাদের দ্বারা তা সম্ভব হতো না। সব সময় একটা ভয় কাজ করতো। আমার মনে হয় ঈদের দিন ছাড়া বাবার কখনো জড়িয়ে ধরার সাহস হতো না। অথচ রাগ শাসন আর রাশভারী চেহারার আবডালে এই মানুষটির যে কোমল হৃদয় তা মাতৃহৃদয়ের চেয়ে কম নয়।
বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহারগুলোর নিঃসন্দেহে একটি। আমরা সন্তানেরা সকল বায়নাই ছিল মায়ের কাছে। এটা চাই। ওটা দাও। মা এসব আবেদন নিবেদন শোনতেন। আর বাস্তবায়ন করতেন বাবা। দিন–রাত পরিশ্রম। খাটুনি। এর সামান্যও নিজের জন্য নয়। বরং আমাদের মুখে হাসি ফোটানোর সব চেষ্টা করতেন বাবা। বাবা ভেঙে পড়তেন না, কাঁদতেন না। কারণ বাবা কাঁদলে বাবা ভেঙে পড়লে আমাদের আর আশা থাকে না কোন।
আমার বাবা পুরাতন নতুন সব আত্নীয় স্বজনের সবসময় খবর নিতেন, দেখাশোনা করতেন। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো ব্যয় করেছেন মানুষের জন্য। যেকোনো বিপদে সমস্যা সংকটে পাড়া প্রতিবেশীর পাশে থাকতেন। বাবা বেশি লেখাপড়া করতে না পারলেও আমাদের সকল ভাই বোনদের শিক্ষা দীক্ষায় মানুষ করেছেন।
বাবা আমাদের শিখিয়েছেন নীতিবান হওয়ার, অন্যের হক নষ্ট না করার, সত্যের পথে অবিচল থাকার, নিজের চাইতে উপরের কারো সাথে বন্ধুত্ব করার, সৎ ভাবে চলার। আমাদের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করছেন বাবা। আদর–শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা ছিল বাবা। বাবার ঋণ কখনো পরিমাপ করতেও পারবো না।
আজ বাবা নেই। কিন্ত একটি দিনও বাবাকে ভুলতে পারি না। বাবাকে খুব মনে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই কোরআন তেলওয়াত করে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা তিনি যেন জান্নাতের শীতল ছায়ায় বাবাকে রাখেন।
পৃথিবীর সকল বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।