বান্দরবানে জুমের ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত জুমিয়ারা

আলাউদ্দিন শাহরিয়ার, বান্দরবান | শনিবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

বান্দরবানে পাহাড়ে আদিপদ্ধতিতে চাষ করা জুমের পাকা ধানে পাহাড়ে লেগেছে সোনালি রঙ। চোখের দৃষ্টির সীমানা জুড়ে দেখা মিলছে সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জুম চাষের পাকা ধানের সোনালি রঙ, যেন সোনালি রং লেগেছে পাহাড়গুলোতে। পাহাড়ের ঢালুতে উৎপাদিত জুম চাষের ধান কাটা শুরু করেছে জুমিয়ারা। জুমের ফসল গড়ে তোলায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জুমিয়া পরিবারের ছোটবড় নারী পুরুষ সবাই।

এ বছর বৃষ্টি দেরিতে হওয়ার কারণে জুমের ধান বপনে সময়ের ব্যবধান বেশি হয়েছে, তাই এখন কেউ ধান কাটা শুরু করেছেন, কোন কোন জুমের ধান এখনো সবুজ আবার কোথাও ধান পাকা শুরু হয়েছে এমন জুমের ধান পাহাড়া দিতে জুমচাষি সপরিবারে জুম খেতে উঠেছেন, কেউ ধান কাটার আগে সাথী ফসল বিশেষ করে মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা ও চিনাল সংগ্রহ করা শুরু করেছেন, আর কেউ জুমের পাকা ধান কাটার জন্য উপযুক্ত সময় অপেক্ষা করছেন। তিন পার্বত্য জেলায় বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় এখন জুমচাষিদের দম ফেলার ফুসরত নেই, জুম চাষ ঘিরে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

সরেজমিনে জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে থানচি উপজেলা বলিপাড়া ইউনিয়ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কমলা বাগান পাড়ায় আদিপদ্ধতিতে পাহাড়ের ঝোপঝাড় পুড়িয়ে পাহাড়ের ঢালুতে চাষ করা জুম খেতের পাকা ধান কাটছেন ১৫ জনের একটা দল। শ্রমিকের সঙ্গে জুমিয়া পরিবারের ছোটবড় সকলে জুমের ফসল গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আশপাশের পাহাড়গুলোতে দূরদূরান্তে শোভা পাচ্ছে জুমের পাকা ধানের সোনালি রং।

জুমচাষি মিলন ত্রিপুরা বলেন, এ বছর ১২ আড়ি জায়গায় (১আড়ি সমান ১০কেজি) ১২ আড়ি ধানের জুম করতে পেরেছেন। এ বছর জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি, কারণ যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ দরকার তখন অতিবৃষ্টি। আগে সময় মতো রোদবৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হতো, এখন সময় মতো রোদবৃষ্টি কিছুই হয়না, প্রকৃতিও উল্টো হয়েছে। এ বছর জুম থেকে ২শ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন যদি জুমের ধান ভালো হতো তাহলে ৩শ আড়ি ধান পেতেন, তারপরও যা পাবেন এ বছর জুমের ধানে কোনমতে বছর যাবে। তিনি যোগ করেন অনেক জুমচাষির জুম এ বছর ভালো হয়নি, যা ভালো হয়েছিল ধান কাটার উপযুক্ত সময়ে টানা ৪৫দিন বৃষ্টি হওয়াতে অনেক জুমচাষির পাকা ধান নষ্ট হয়েছে, তাই আগামী বছরও পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতে সাময়িক খাদ্য সংকট তৈরি হতে পারে।

জুমচাষি পুষ্পরানী ত্রিপুরা বলেন, তারাও জুম চাষ করেছেন কিন্তু তাদের জুমের ধান এখনো কাটার উপযুক্ত হয়নি তাই তাদের প্রতিবেশী দুলাভাইয়ের পাকাধান শ্রমের বিনিময়ে কাটতে সহযোগিতা করছেন। কিছুদিন পর তাদের জুমের ধান কাটার উপযুক্ত সময় হলে তাদের থেকেও শ্রম দিয়ে জুমের ধান কাটার সহযোগিতা পাবেন।

প্রতিবছর নভেম্বরডিসেম্বর মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করা হয়, জানুয়ারিফেব্রুয়ারি মাসে জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জঙ্গল কাটা হয়, তারপর কাটা জঙ্গল রোদে শুকানোর পরে মার্চএপ্রিল মাসে কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়ার জন্য প্রথমে ফায়ারিং লাইন করে জঙ্গল পোড়ানো হয়, এপ্রিল মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার করে ধান বপণের জন্য প্রস্তুত করে কাক্সিখত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে, বৃষ্টি হলেই জুমের জায়গায় ধানসহ সাথীফসল বপন করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধানসহ সাথীফসল বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে আর যারা একটু দেরিতে বপন করেন তাদের ধান দেরিতেই পাকে। প্রতি বছর আগষ্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বরঅক্টোবর পযর্ন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানো প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব।

কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, বান্দরবান জেলায় জুম আবাদের তথ্যমতে বিগত ২০২১ সালে আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ৩শত ৭৮ হেক্টর জায়গায় আর উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৪শত ৬৭ দশমিক ২২ মেট্রিক টন চাউল, ২০২২ সালে আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ২শত ৯২ হেক্টর জায়গায় আর উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৪শত ১৮ দশমিক ১২ মেট্রিক টন চাউল, ২০২৩ সালে জুম চাষ আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৫শত ৪০ হেক্টর জায়গায় আর উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৪শত ৮৯ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন চাউল, চলতি বছর ২০২৪ সালে জুম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৪শত ৬০ হেক্টর জায়গায়, আবাদ অর্জনে ৮ হাজার ২শত ৬৭ হেক্টর, আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ মেট্রিক টন চাউল, বর্তমানে জুমের ধান কর্তন চলমান রয়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. হাসান আলি জানান, চলতি বছর প্রায় ৮ হাজার তিনশত হেক্টর জায়গায় জুমের আবাদ হয়েছে। জুমে ধান ছাড়াও সাথীফসল হিসেবে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। এ বছর জুমের ফলন ভালো হবে আশা করা যায় তবে পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে বৃষ্টি সব জায়গায় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয়না যার কারণে উৎপাদনে তারতম্য হয়, একেক জায়গার ফলন একেক রকম হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলায় জুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে আর অন্যান্য উপজেলায়ও জুমের ধান কাটা শুরু হবে। জুমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষিবিভাগ বিভিন্ন পরামর্শ এবং স্থানীয় জাতের সাথে হাইব্রিড জাতীয় ধান উৎপাদন করার জন্য উৎসাহ ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে বলে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাহাড়ে পাকা ধানের সুবাস
পরবর্তী নিবন্ধচুনতিতে সওজের জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণ