বাংলার মনি

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ৪ মার্চ, ২০২৪ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালে কোভিডের সময়ে মেসেঞ্জারে আমার সঙ্গে কথোপকথন -“স্যার, আমাকে মনে আছে? আমি আহসান, ইংল্যান্ডে থাকি। বাংলার মনি জাহাজে আপনি সেকেন্ডইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তখন আমি প্রথম জাহাজে জয়েন করেছিলাম ডেকক্যাডেট হিসাবে। আমি নিজেই এখন অনেক বছর হলো ক্যাপ্টেন; রিটায়ারও করবো অতি সত্বর। কিন্তু একটা কারণে আপনাকে এখনো মনে আছে, আমার এত বছরের সীলাইফে আপনিই একমাত্র মেরিনার, যিনি কিংবদন্তীর মত নিজের বিয়ে নিজেই মিস্‌ করতে যাচ্ছিলেন”।

আলবৎ মনে আছে! কথাটা খুব বেশী ভুল বলে নাই বা বাড়িয়েও বলে নাই। সেরকমই হতে যাচ্ছিলো আমার কপালে। ১৯৯১এর অক্টোবরে এন্‌গেজমেন্ট করে জাহাজে মাস পাঁচেক কাটিয়ে এসেছি। মানসিকভাবে বেশ কষ্টের ব্যাপারই বটে। এতদিন বাবামাভাইদের ছেড়ে থাকতে এক ধরনের কষ্ট হতো; এখন যুক্ত হয়েছে বিশেষ আরেকজন। তাই ঠিক করলাম, বিএসসির জাহাজেই কাজ করি কয়েকটা মাস। বাংলাদেশী জাহাজ, তাই চট্টগ্রামে তো প্রায়ই আসবে, আমিও ঘনঘন বাসায় যেতে পারবো (নিজবাসা ও হবুশ্বশুরের বাসাদুইটাই চট্টগ্রামে)। কন্ট্রাক্ট শেষে বিয়ে করে দুজনে ইংল্যান্ডে যাবোহানিমুনও হবে; আর চীফইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রীটাও নিবো। চরম ভুল হয়েছিলোপুরা ধরা খাচ্ছিলাম।

১৯৯২এর জুলাইতে বোম্বেতে বিএসসির জাহাজ, এম.ভি. বাংলার মনিতে উঠলাম। ছয় মাসেরও বেশী ছিলাম; আফ্‌সোস! একবারও চট্টগ্রামে এলো না। বোম্বে থেকে করাচীতে এলাম। এই আমার প্রথম পাকিস্তানে আসা। আব্বা গ্ল্যাক্সোর চীফক্যামিস্ট হিসাবে, ১৯৬০এর দশকে বেশ কয়েক বছর করাচীতে ছিলেন। আমার তিন ভাইয়ের জন্মও সেখানে। আব্বাআম্মা যেরকম সুন্দর করাচীর কথা বলতেন, সেরকম কিছুই দেখলাম না। ভীষণ নোংরা, মানুষেগাড়িতে গিজগিজে শহর। সেখানে অন্য আরেকটা বিএসসির জাহাজ ছিলো, আমরা কয়েকজনে মিলে ঘুরতাম শহরে। একটাই ভালো কাজ করতে পেরেছিলামসকলের সুপরামর্শে সেখান থেকে খুবই সুন্দর, ভারী ও দামী একটা লেহেঙ্গা কিনে ফেলেছিলামনিজের বিয়ের বাজারের ধারাবাহিকতা।পরে অনুষ্ঠানে সেই লেহেঙ্গা অবশ্য খুবই প্রশংসা কুড়িয়েছিলো।

করাচী থেকে আরবসাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলোতে গেলামকেনিয়ার মোম্বাসা, তাঞ্জানিয়ার দারএসসালাম, জাঞ্জিবার। সেখানে কর্মরত প্রচুর ভারতীয় এবং কিছু কিছু বাংলাদেশীদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ হলো। বাংলাদেশী এক পরিবার আমাদেরকে তাদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলেনও। জাঞ্জিবার ও দারএসসালামে এখনো মানবইতিহাসের কালোঅধ্যায়ের ভয়ঙ্কর স্মৃতি হিসাবে রয়েছে ক্রীতদাস বেচাকেনার বাজার।

কেনিয়া, তাঞ্জানিয়ার উত্তরেই রয়েছে সোমালিয়া। গত বিশপঁচিশ বছর ধরে সেখানে চলছে জলদস্যুদের ত্রাসের রাজত্ব। ওদের সীমানার আশেপাশে যে কোনো জাহাজ গেলেই, আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দ্রুতগামী স্পিডবোটে এসে জাহাজ আক্রমণ করে, আটক করে মুক্তিপণ আদায় করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জাহাজের ক্ষতি হয়েছে, মেরিনাররা মারা গেছে বা আহত হয়েছে। অনেকেই বন্দীদশা কাটিয়েছে। তবে ১৯৯১/৯২এর দিকে তেমন উপদ্রব ছিলো না; তাহলে আমরাও নিরাপদে সেখান দিয়ে যেতে পারতাম না। সেসময়ে ইন্দোনেশিয়ামালোশিয়াসিঙ্গাপুরের মালাক্কাস্ট্রেইটে জলদস্যু বেশী ছিলো। আমি অবশ্য নিজদেশে, মংলাবন্দরে জলদস্যুদের আক্রমণে পড়েছিলাম। একদম দিনের আলোয়, বেলা তিনটাচারটার দিকে। সুন্দরবনের দিক থেকে দেশী নৌকায় চড়ে এসেছিলো। আমরা হাতের কাছের ভারী যন্ত্রপাতি, লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া শুরু করলে, তারা আশিএকশ’ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়ে সাঁতরে পালিয়ে গিয়েছিলো।

যাহোক, আবারো বাংলার মনি জাহাজে ফিরে আসি। এটা ১৯৮৩তে জার্মানীতে তৈরি জেনারেল কার্গো জাহাজ। আমরা যখন মেরিন একাডেমিতে পড়ছি, তখন বিএসসি এই ঝকঝকে নতুন জাহাজ কিনেছিলো। আমরা পূর্বআফ্রিকার দেশগুলো ছেড়ে ইয়েমেনের আলহুদাইদাহ, এডেন, আলমুকাল্লা বন্দরে গেলাম। সেখান থেকে ওমানের সালালাহ্‌ হয়ে দুবাই হয়ে ইরানের বন্দরআব্বাস ও বন্দরইমামখোমেনী। ইয়েমেনে বেশী কিছু করার নাই, সেখানের হোটেলের গরম কাবাবরুটির কথা মনে পড়ে। আর একটা জিনিস খুব চোখে পড়েছিলোতাদের বিল্ডিংএর স্ট্রাকচারগুলো। আমার কাছে মনে হতো ক্বুরআনে বর্ণিত পাহাড়ের গায়ে মাটির তৈরি আবাস্থসলের মতএটা সম্পূর্ণ আমার মতামত। এখন নিশ্চয়ই অনেক উন্নত বিল্ডিং তৈরি হয়েছে; যদিও সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে গত কয়েক বছর ধরে।

দুবাইতে আমার চেনাপরিচিত এক পরিবার থাকেনডাঃ আতিয়ার রহমান ও ডাঃ শামস রহমান। শামস আপার আব্বাআম্মা চট্টগ্রামে আমাদের প্রতিবেশী। আগেও প্রচুর ওনাদের বাসায় গিয়েছি। আবারো গেলাম ওনাদের সঙ্গে দেখা করতে। খুবই খুশী হলেন। ওনারা ১৬ ডিসেম্বরের স্থানীয় এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন; আমিও গেলাম। সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালো প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে। এরপরে, বন্দরআব্বাসে, ছয়সাতদিন একনাগাড়ে থাকার কারণে সেখানেও অনেক ঘুরেছি। আবারো একটা বাংলাদেশী জাহাজ পেয়েছিলামআমরা সকলে একসঙ্গে বের হতাম, ঘুরে বেড়াতাম, পালা করে দুই জাহাজে দাওয়াত খাওয়া হতো। খুব মজাতেই দিন কাটছিলো।

অফিস থেকে খবর এলো সৌদি আরবের জেদ্দা ও জর্ডানের আকাবা যেতে হবে। আমার আবার এদিকে বাসায় ফেরার সময় এসে যাচ্ছে। পাঁচমাস কাজ করলেই প্রয়োজনীয় সীটাইম হয়ে যাবে চীফইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার জন্যে। সেই হিসাবে প্ল্যানও করেছিলাম এবং বিএসসির সঙ্গে কন্ট্রাক্টও করেছিলাম পাঁচমাসের। জাহাজে সাধারণতঃ দুএকসপ্তাহ এদিকওদিক হয়, কিন্তু এখন পাঁচমাসের অনেক বেশীই হয়ে যাচ্ছে। দেশে সকলে আমার কাছে ফেরার তারিখ জানতে চায়তাহলে সেই মতো বিয়েবৌভাত ইত্যাদির তারিখ ঠিক করবে, কার্ড ছাপাবে, হল ভাড়া করবে। কিছুই করা যাচ্ছে না। কারণ, আমি নিজেই জানি না কবে, কোথা থেকে ফেরত যাবো। আমি বারেবারে চট্টগ্রামের অফিসে মেসেজে তাগাদা পাঠাতে থাকলাম, সত্বর আমাকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্যে। উত্তর দেয় না। লোকমুখে শুনি, আমার বদলী বা রিলিভার কোনো সেকেন্ডইঞ্জিনিয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে জাহাজ পার্সীয়ানগালফ থেকে হরমুজপ্রণালী দিয়ে বের হয়ে গাল্ফঅফওমানে পড়লো। সেখান থেকে আরব সাগর ধরে গালফঅফএডেন হয়ে “দুঃখের দরজা”বা বাবআলমান্দাব (Bab-al-Mandeb) দিয়ে লোহিত সাগরে। এখানে আদিযুগে প্রচুর নাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলো বলে এই নামকরণ। আবার ধারণা করা হয়, এক প্রচন্ড ভূমিকম্পে অনেকেই মারা গিয়েছিলোসেই থেকেই এই নাম। জেদ্দায়ও দুইতিনদিন ছিলাম। অনেকবার সেদেশে গিয়েছিজাহাজে করে কয়েকবার, পরবর্তীতে অ্যামেরিকায় কাজ করার সময়েও কয়েকটা বিজনেসট্রিপে, এছাড়া হজ্জ্বঊমরাহও করেছি কয়েকবার। কিন্তু কখনই সৌদি সিস্টেম ও সেখানের কিছু কিছু মানুষকে (কাস্টম্‌স্‌ইমিগ্রেশানপুলিশসরকার) একদমই পছন্দ হয়নাই। বন্দরে জাহাজ ভিড়লেই একজন আম্‌ড্‌র্গার্ড জাহাজের সিঁড়ি বা গ্যাংওয়ের সাথে চব্বিশ ঘন্টা থাকবে। কাউকেই নামতে দিবে না। এমনকি, আমাদের অতি প্রয়োজনীয় ইনফরমেশানপানির উপরে জাহাজের উচ্চতা (ড্রাফ্‌ট্‌) মাপার জন্যে ডিউটি অফিসারকেও না। মনে হতো সাদা চামড়াদের জন্যে তাদের আইন শিথিল; কিন্তু এশিয়ান, বিশেষ করে উপমহাদেশীয়দের জন্যে ভিন্ন ও কঠোর আইন। আমরা শিক্ষিত অফিসারেরা এধরনের বৈষম্য বুঝতাম। আমি সেখান থেকে দেশে ফেরার আশা করতেও পারি না।

জেদ্দা থেকে রওনা দিলাম রেডসী ধরে। মিশরের রিসোর্ট শার্মএলশেইখের কাছে ইংরেজি ণ অক্ষরের মত দুইদিকে দুইটা নৌপথ চলে যায়। উত্তরপশ্চিমে গালফঅফসুয়েজ দিয়ে সুয়েজ ক্যানালে পৌঁছাবেন। আমরা ডানপাশেরটা, মানে উত্তরপূর্বদিকে গালফঅফআকাবা ধরে আকাবা বন্দরে এলাম। জর্ডান আর ইস্রায়েল কিন্তু অনেক লম্বা বর্ডার শেয়ার করে। ম্যাপে যদি আকাবা খুঁজে দেখেন, দেখবেন যে, এর ঠিক উল্টাপাশে, দুইতিন মাইল পশ্চিমেই ইস্রায়েলের এইলাত (Eilat) বন্দর। আমরা আকাবা থেকেই তাদের শহরের গাড়িঘোড়া, লাইট সব দেখতে পারছিলাম। আকাবাও বেশ উন্নত শহর।

যা হোক, আকাবাতে এসে শুনি আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে; অথচ আমি নিজেই জানি না যেতে পারবো কিনা। অফিস থেকে আমার রিলিভার হিসাবে একজনের নাম দিয়েছিলো, কিন্তু তার এতই সুনাম(!) যে, আমাদের জাহাজের চীফইঞ্জিনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। এবারে আমাকে একটু কঠোরতার আশ্রয় নিতে হলো। আমার রিলিভার অযোগ্য, সে কাজ পারে না, ঝামেলা হয়, সেটা আমার মাথাব্যথা হবে কেন? আমার বিয়ের তারিখ, ইংল্যান্ডে যাওয়ার তারিখ সব ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে নামাতেই হবে। অনেক আলাপআলোচনার পরে সমঝোতা হলো। ঠিক হলো, সেই রিলিভারকে আনা হবে না; বিকল্প হিসাবে জাহাজের বর্তমান যে সমস্ত জুনিয়ারইঞ্জিনিয়াররা আছে, তাদের দিয়েই জাহাজ চালানো হবে। তবুও সেই সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার এনে জাহাজে বিপদ ঘটানোর রিস্ক নিতে চাইলেন না কেউই। অন্যদিকে আমিও বা নিজের বিয়ে নিয়ে রিস্ক নিবো কেনো? যদি আমি সময়মত দেশে যেয়ে না পৌঁছাতে পারি, আর আমার বিকল্পবর খোঁজ করা শুরু করে দেয়? যাক, সেটা আর হতে দেই নাই। শুভ সমাপ্তি ঘটেছিলো সেবার।

মরিনো ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া ২০২৪

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিঝুম দ্বীপের নিঃসীম নিরালায়
পরবর্তী নিবন্ধটোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এইউডব্লিউর চুক্তি স্বাক্ষর