বডি রং করে রাস্তায় লক্কর-ঝক্কর গাড়ি

ঈদ সামনে রেখে ওয়ার্কশপে মিস্ত্রিদের ব্যস্ততা

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

রাস্তায় বের হলে চোখে পড়ে লক্কর-ঝক্কর গাড়ি। কোনোটির গায়ে সদ্য রং লাগানো। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে চলাচল করলে আটক ও জরিমানা করছে পুলিশ কিংবা বিআরটিএ। কিন্তু কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নির্বিঘ্নে চলছে এ সব গাড়ি। যাত্রীরা নিরুপায়। ঝুঁকি নিয়ে এ সব গাড়িতেই চলাচল করতে হয়। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর গাড়ি ‘নতুন’ হয়ে ওঠে। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে লক্কর-ঝক্কর গাড়ি মেরামতে কারিগর ও রং মিস্ত্রিদের ব্যস্ততা অনেক গুণ বেড়ে যায়। তারা বলছেন, পুরনো গাড়ির ‘বডি’ রঙিন হলেই মিলে যায় পথে নামার অনুমতি। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অভিযান পরিচালনা করার পর কিছুদিন বন্ধ থাকে, পরে ‘যেই লাউ সেই কদু’ হয়ে যায়। পুলিশ ও বিআরটিএ জানিয়েছে, নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। লক্কর-ঝক্কর গাড়ি পেলে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। যতই রঙ করা হোক, ফিটনেস না থাকলে গাড়ি পথে চলতে পারবে না। সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ আজাদীকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অসংগতিপূর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। রাস্তায় চলাচলরত অবৈধ কোনো গাড়িকে ছাড় দিচ্ছি না। সার্জেন্টদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু গাড়ি পার পেয়ে যায়, তারপরও নিয়মিত মামলা ও জব্দ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এদিকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন যান চালালে ছয় মাস কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাস কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধানসহ জেল-জরিমানাও অনেক বেশি। কিন্তু তাতেও জরাজীর্ণ গাড়িগুলোর চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। শনিবার রাত সাড়ে নয়টা। নগরীর আগ্রাবাদ বিদ্যুৎ অফিসের সামনে হঠাৎ থেমে গেল গাড়ি। যাত্রী আর হেলপারের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে। যাত্রীরা হেলপারকে মারধর করতে উদ্ধত হয়েছেন। কারণ লক্কর-ঝক্কর গাড়ির যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে গেছে। একইদিন বিকেলে নগরীর লালখান বাজার এলাকায় ১০ নম্বর রুটের আরও একটি গাড়ি বিকল হয়ে যায়। গাড়ি থেকে যাত্রী ও হেলপার নেমে গাড়ি ধাক্কা দিতে দেখা গেছে। গাড়িটি প্রধান সড়ক থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এক পাশে।
নগরীতে প্রায় প্রতিদিনের চিত্র এমনই। লক্কর-ঝক্কর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে মাঝপথে থেমে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে গাড়ির যন্ত্রাংশ। ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অনেক সময় যাত্রীদের হেঁটে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ যাত্রীরা।
জানা গেছে, চলতে চলতে হঠাৎ গাড়িগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া, গাড়ির বডি ভাঙা, লাইট ঠিকমত না জ্বলা ও অন্যান্য সমস্যার ফলে দুর্ঘটনা এবং যাত্রী হয়রানির ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। নগরীর সড়কগুলোতে অবাধে চলছে এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি। কিন্তু বাস-মিনিবাস, টেম্পো, হিউম্যান হলারসহ ৮০ ভাগ যানবাহনের নেই ফিটনেস সনদ। কেস স্লিপ দিয়েই চলছে বেশির ভাগ বাস। বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসন, বিআরটিএ ও সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যানবাহন জব্দ করে, মামলাও হয়। কিন্তু এ সব উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসে না।
নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, কোতোয়ালী, ষোলশহর ২ নম্বর গেট থেকে চকবাজার, কোতোয়ালী থেকে নতুন ব্রিজ, দেওয়ানহাট থেকে অলংকার এবং নয়া বাজার বিশ্বরোডে চলছে লক্কর-ঝক্কর গাড়ি। যেগুলোর কোনো ফিটনেস নেই, নেই কোনো লাইসেন্সও। গাড়ির পেছনের নম্বর প্লেটও নেই। কোতোয়ালী, ষোলশহর ২নং গেট থেকে চকবাজার, কোতোয়ালী থেকে নতুন ব্রিজ, দেওয়ানহাট থেকে অলংকার এবং নয়া বাজার বিশ্বরোডে চলছে লক্কর-ঝক্কর টেম্পু। যেগুলোর কোনো ফিটনেস নেই। বাসগুলোর একটা অংশের জানালার কাঁচ ভাঙা, কোনটির হেডলাইট, সিগন্যাল লাইট নেই। আবার কোনো বাসের সিট নড়বড়, খুলে পড়ছে গাড়ির বডির বিভিন্ন অংশ। কোনোটির রং চটেছে বহু আগেই।
যাত্রীদের অভিযোগ, একই রুটের দুইটি বাস একত্রে গেলে একটার সাথে অন্য আরেকটির অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কার আগে কে যাত্রী উঠাবে এমন মনোভাব থাকে চালকদের মনে। বাস চালক হেলাল উদ্দিন বিষয়টির সত্যতা অস্বীকার না করে বলেন, দিন শেষে গাড়ির মালিকের হাতে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা তুলে দিতে হয়। সে জন্য আমরা ইনকাম করতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি। আমাদের চাহিদার টাকা সমপরিমাণ হয়ে গেলে, গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিই। প্রতিযোগিতার ফলে দুর্ঘটনার ব্যাপারে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা হবে সেটি আমি মানি। তবে নগরীর রুট ভিত্তিক বাসগুলোর চালকদের স্বভাব এ রকমই। তাদের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গেলে এমনই করতে হবে। অর্থাৎ অন্যান্য চালকরা যে রকম আচরণ করে আমিও তেমনই আচরণ করি। মাঝে মাঝে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী উঠানামা করালে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করেন।
বাসযাত্রী খোকা বলেন, ফিটনেস না থাকার পরও শুধু রঙ দিয়ে গাড়িগুলো রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এর ফলে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এই গাড়িগুলোর উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। এখানে প্রশাসনের কোনো নজরদারিই নেই।
দিলরুবা খানম নামে এক যাত্রী বলেন, টেম্পুগুলোর কোনো ফিটনেস নেই। চালকের লাইসেন্স আছে কিনা আমরা কখনো যাচাই করি না। সময় হাতে নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাই, এত কিছু জিজ্ঞেস করতে তো আর পারি না। চালকের লাইসেন্স আছে কি নেই তা যাচাই করার জন্য তো পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তারা কেন নীরবে বসে থাকেন?
হাসিনা আক্তার নামে অপর এক যাত্রী বলেন, ড্রাইভারদের যদি লাইসেন্স না থাকে তাহলে আমরা থাকি বিপদে। তারা ড্রাইভারদেরকে কোনো পরীক্ষা না করে টাকার আশায় লাইসেন্স দিয়ে দেয়। এ চালকদের প্রতিহত করা দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই হত্যা মামলার আসামি ১৭ বছর পর ধরা
পরবর্তী নিবন্ধঈদে ছুটি মিলতে পারে ৯ দিন