কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। মাছ না পাওয়ায় গত এক মাস ধরে কক্সবাজারের ৮০ ভাগ ট্রলারই সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখে ঘাটে নোঙর করে রেখেছে। এর ফলে কক্সবাজারের অর্ধলক্ষাধিক জেলে–শ্রমিক কর্মহীন অবস্থায় আর্থিক অনটনে পড়েছেন। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের তথ্যও বঙ্গোপসাগরে মাছের আকালের সত্যতা নিশ্চিত করছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) তথ্য মতে, কক্সবাজার শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাটে গত বছর (২০২৩ সাল) ৪ এপ্রিল ৭০ দশমিক ২৫ মেট্রিক টন মাছ অবতরণ করেছিল। আর ২০২৪ সালের ৪ এপ্রিল বা গতকাল বৃহস্পতিবার অবতরণ করেছে মাত্র ১১ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন মাছ, যা গতবছরের এই সময়ের তুলনায় মাত্র ১৬%। তা ছাড়া গত মার্চ মাসে ফিশারিঘাটে ৫৭৮ মেট্রিক টন মাছ অবতরণ করে। অথচ ২০২৩ সালের মার্চ মাসে অবতরণ করেছিল ৭৯০ মেট্রিক টন মাছ।
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. বদরুদ্দৌজা বলেন, এবছর কক্সবাজার উপকূলে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ কম ধরা পড়েছে। ফিশারিঘাটে মৎস্য অবতরণের দৈনন্দিন রেকর্ড এমন তথ্যই নিশ্চিত করছে। তবে কী কারণে মাছ কম ধরা পড়ছে, তা গবেষকরাই ভাল বলতে পারবেন।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাসিবুল ইসলাম বলেন, সাগরে জেলিফিশের সংখ্যা বেড়ে গেলে মাছের সংখ্যা কমে যায়। হয়তো বঙ্গোপসাগরে জেলিফিশের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছের সংখ্যা কমে গেছে।
বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী ও কক্সবাজারের সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা ম. কবির আহমদ বলেন, ইলিশ একটি উচ্চ পরিযায়ী (মাইগ্রেটরি) প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। খাদ্য ও উপযুক্ত পরিবেশের কারণে তারা সাগরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। কক্সবাজার উপকূলে ইলিশ ধরা না পড়লেও বঙ্গোপসাগরের অন্য উপকূলে বেশি ইলিশ ধরা পড়তে পারে। বিষয়টি গবেষণা হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের অবতরণ সম্পর্কে তথ্য নিতে বিএফআরআই চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের একটি দল আজ বৃহস্পতিবার (গতকাল) কক্সবাজারে এসেছে। তারা বিষয়টি জরিপ শেষে সাংবাদিকদের অবহিত করবেন।
কক্সবাজার জেলে–বহদ্দাররা (ট্রলার মালিক) বলছেন, চলতি মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে আশানুরূপ মাছের দেখা নেই। গত এক মাস ধরে এ পরিস্থিতি হয়ে পড়েছে আরো নাজুক। জেলেরা ইলিশ ধরার জন্য ৮/১০ দিনের রসদ নিয়ে সাগরে গেলেও অধিকাংশ ট্রলারই প্রায় খালি হাতেই ফিরছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বর্তমানে কক্সবাজারের প্রায় ৮০ ভাগ ট্রলারই সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ বলেন, কক্সবাজারে ছোট বড় ৭ সহস্রাধিক যান্ত্রিক বোট রয়েছে। এরমধ্যে বড় নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ জন এবং ছোট নৌকায় ৫ থেকে ১৭ জন জেলে থাকে। আবার কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগর ঘাটের ইঞ্জিনবিহীন ককশিটের বোটে থাকে মাত্র ২ জন জেলে। ট্রলারগুলোর মধ্যে ইলিশ জালের বোটগুলো ৮/১০ দিনের রসদ নিয়ে এবং তাইল্যা জালের বোটগুলো এক সপ্তাহের রসদ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। আবার ৭/৮ আঙুলের ফাঁসযুক্ত ফইল্যা জালের বোটগুলো সাগরে মাছ ধরতে যায় ৫/৬ দিনের রসদ নিয়ে। এই বোটগুলো রূপচান্দা জাতীয় মাছ ধরে। এছাড়া চাউপ্পা জাল, ডোবা জাল, চামিলা জাল ও চোখফোলা জালের বোটগুলো মাত্র একদিনের রসদ নিয়ে সাগরে যায় এবং মাছ ধরে দিনে দিনেই ফিরে আসে। এই ধরনের জালের বোটগুলো সাগর উপকূলে ছোট প্রজাতির মাছ ধরে, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাঁচকাড়া’ (পাঁচ প্রকারের) মাছ বলা হয়। বোটগুলোতে একেক মৌসুমে একেক প্রজাতির মাছ বেশি ধরা পড়ে। তবে কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়া মাছের ৬০ ভাগই ইলিশ।
তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়েনি। যেগুলো ধরা পড়েছে, সেগুলোও আকারে খুব ছোট। এছাড়া অন্যান্য জাতের মাছের অবস্থাও একই। ফলে কক্সবাজারের একেকজন ট্রলার মালিক এখন কোটি টাকার ঋণ বহন করছে। অনেক ট্রলার মালিক লোকসান সহ্য করতে না পেরে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের প্রায় আশি শতাংশ ট্রলারই সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখে। বর্তমানে ট্রলারগুলো শহরের কস্তরাঘাটস্থ পোতাশ্রয়ে নোঙর করে রাখা হয়েছে।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। এরমধ্যে ইলিশ ধরা হয় ৪ থেকে ৫ আঙুলের ফাঁসযুক্ত সুতার জাল দিয়ে, যেটি ভাসা জাল নামেই জেলেদের কাছে পরিচিত। আর সাগর থেকে তাইল্যা ও কোরাল মাছ ধরা হয় ২ থেকে ৩ আঙুলের ফাঁসযুক্ত এক ধরনের রক জাল দিয়ে, যেটি তাইল্যা জাল নামেই পরিচিত। কিন্তু গত চলতি মৌসুমে ভাসা জালে আশানুরূপ ইলিশ ধরা না পড়ায় অধিকাংশ জেলে তাইল্যা জালের দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু তাইল্যা জালেও এখন আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়ছে না। ফলে অনেক ট্রলার মালিক মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে অর্ধ লক্ষাধিক জেলে–শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। আগামী ঈদ তাদের কীভাবে কাটবে, এ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত।
কক্সবাজার শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাট। বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে প্রতিদিন এখানে অসংখ্য ট্রলার আসে। এখান থেকে ইলিশসহ অন্যান্য মাছগুলো ট্রাকবোঝাই করে পাঠানো হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। গতকাল বৃহস্পতিবারও এখান থেকে মাত্র একটি মিনি ট্রাকে মাত্র এক মেট্রিক টন মাছ ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ফিশারিঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী।
তিনি বলেন, সাগর থেকে গত এক মাস ধরে দৈনিক গড়ে ২/৩ টনের বেশি ইলিশ আসছে না। আর গত পক্ষকাল ধরে তা এক–দুই টনে নেমে এসেছে। অথচ অন্যান্য বছর খুব খারাপ সময়েও দৈনিক ১৫/২০ টন মাছ এসেছে, যার অধিকাংশই ইলিশ।