বঙ্গবন্ধু টানেল : খুলে যাচ্ছে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগের স্বর্ণদুয়ার

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগের স্বর্ণদুয়ার খুলে যাচ্ছে। যান চলাচলের জন্য অচিরেই উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। টানেলের রাস্তা এবং এপ্রোচ রোডসহ যাবতীয় কাজই শতভাগ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধনের কথা রয়েছে। দক্ষিন এশিয়ায় কর্ণফুলীর নদীর তলদেশেই প্রথম টানেল নির্মিত হলো, চট্টগ্রামই নদীর তলদেশে প্রথম টানেল দেখলো চীন ভারতসহ বিস্তৃত দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে। এই টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রামের আবাসন, শিল্পায়ন, পর্যটনসহ সার্বিক জীবনযাত্রায় ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যা দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

সরকার চীনের সাংহাই নগরীর আদলে গড়ে তুলতে চায় চট্টগ্রামকে। একটি নদী যেমন সাংহাইকে দুভাগ করেছে। উভয়পাড়ে সুউচ্চ সব ভবনের টাউনশিপ গড়ে তোলা হয়েছে। ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ নামের ওই মডেলেই কর্ণফুলী নদীর অপরপাড়ে টাউনশীপ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহন করা হয়।

বহুদিন ধরে টানেলের বিষয়টি আলোচিত হলেও এটি বাস্তবায়নের পর্যায় শুরু হয় ২০১৩ সালে। ওই সময়কার এক সমীক্ষায় দক্ষিন চট্টগ্রামের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই টানেল অর্থনৈতিকভাবে খুবই জরুরি ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সমীক্ষায় বলা হয় যে, টানেলের ভিতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রতিদিন চলাচল করতে পারবে অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন যাতায়াত করার কথাও সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পর বিস্তারিতভাবে প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৫ সালের নভেম্বরে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মাল্টিলেন রোড টানেল প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ওই সময় প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশের প্রথম টানেল হিসেবে দুইটি টিউবের একটির বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।

চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণ কাজ পরিচালনা করছে।

শুরুতে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও নির্মাণ সামগ্রির মুল্যবৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহন খরচ বৃদ্ধি এবং করোনাকালে কাজের বহুমুখী ক্ষতি হওয়ায় খরচ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এবং বাকি অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হার সুদে এই ঋণ দিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, মুল টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এছাড়া ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের অ্যাপ্রোচ রোডের পাশাপাশি ৭২৭ মিটারের একটি ওভারপাসও রয়েছে।

কর্ণফুলী নদীর একপাড়ে বন্দরনগরী গড়ে উঠলেও অপরপাড়ে রিক্সা চলেনা এমন বহু রাস্তা রয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও একেবারে তলানিতে। এই টানেল নির্মাণের ফলে আনোয়ারা, পটিয়া, কর্ণফুলী, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বান্দরবান এবং কক্সবাজারসহ দক্ষিণের বিস্তৃত এলাকায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এই টানেলের সাহায্যে দক্ষিন চট্টগ্রামের চেহারা পাল্টে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকাচট্টগ্রামকক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রে এই টানেল মুখ্য ভূমিকা রাখবে।

টানেল চালু হলে ঢাকাসহ পুরোদেশ থেকে কক্সবাজার, বান্দরবানসহ দক্ষিন চট্টগ্রামমুখী বিভিন্ন গাড়ি শহরে না ঢুকে ফৌজাদারহাট থেকে আউটার রিং রোড ধরে টানেল হয়ে গন্তব্যে যাতায়াত করবে। এই টানেল চট্টগ্রাম শহরের উপর যানবাহনের চাপ কমাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

টানেলের প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় সব কাজই শেষ হয়েছে। টানেলের ভিতরে রাস্তা, অ্যাপ্রোচ রোড, বৈদ্যুতিক সংযোগ, ক্রস কানেকশনসহ প্রয়োজনীয় সব নির্মাণই শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সার্ভিস এরিয়াতে টুকটাক কিছু কাজ বাকি থাকলেও তা যান চলাচলের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টানেল উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। তিনি উদ্বোধন করার পরই যান চলাচলের জন্য টানেল উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅযত্নে, অবহেলায় রূপ ও যৌবন হারাতে বসেছে আসকারদিঘি
পরবর্তী নিবন্ধএকাদশে ভর্তি : আস্থার শীর্ষে ডিজিটাল কলেজ সিএসবিএইচ