আমি একাত্তরের ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ বিশ্লেষণ করার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত ছিলাম বেশ কিছুদিন। এটি করতে গিয়ে, অনেক নিবন্ধ পড়েছি কিন্তু সেগুলোর কোনটিই আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনি। কারণ এগুলো খুব অগভীর প্রকৃতির।
প্রকৃতপক্ষে এই মহান ভাষণকে কীভাবে বাস্তবে রূপান্তর করা যায় সে সম্পর্কে আবেগগত বিশ্লেষণ একটি পথ প্রদর্শন করতে অক্ষম। তবে এই ভাষণ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এই ভাষণকে কেন্দ্র করে দেশের উন্নয়ন কৌশল আবর্তিত হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এ ধরনের উন্নয়ন কৌশলই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমরা যুক্তি দিতে পারি, এই ভাষণটি ছিল ২৩ বছর আমাদের শাসনকারী বর্বর পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ–নির্যাতন থেকে দেশের স্বাধীনতার ভাষণ। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই ভাষণ মুক্তিযোদ্ধা ও জাতিকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রেরণা দিয়েছিল।
এই ভাষণটিকে নৃশংস পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল–বদর এবং আল–শামসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত মৌলিক এবং কার্যকর নরম অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। আমরা বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে দেখতে পাই, ট্যাঙ্ক এবং গোলাবারুদ সমন্বিত সামরিক অস্ত্রের সরঞ্জামের মতো শক্ত অস্ত্রের চেয়ে নরম অস্ত্র বেশি কার্যকর। স্বীকার করতে হবে যে, এই নরম অস্ত্রের মাধ্যমেই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের মিত্রদের তুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা উল্লেখযোগ্যভাবে কম সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এ জাতির স্বাধীনতা এনে দেন। তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকেও এই ভাষণটির বিশ্লেষণ করা উচিত।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের পর, বিশেষ করে ১৯৯৬ সালের ১১ই জুন পর্যন্ত, আমাদের দেশের অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচিত। এই ভাষণটি তখন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একটি অসাধারণ অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর থেকে ২০০৮ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে আবার অন্ধকার যুগ চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। তাই সেই সময়ে এই ভাষণের প্রভাব উপলব্ধি করতে পারিনি। তবে দেশের অন্ধকার যুগে যখনই এই ভাষণ শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এই ভাষণ আমাকে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও উদ্যমী করে তুলেছে। এই বিশ্লেষণাত্মক বিশ্লেষণ থেকে, যুক্তি দেওয়া যেতে পারে, এই ভাষণটি অমৃত শক্তির অধিকারী; যা পৃথিবী থেকে কখনও বিলুপ্ত হবে না। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের অন্ধকার যুগে স্বাধীনতা বিরোধীরা নানাভাবে এই ভাষণ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল।
তবে দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের প্রতিটি আনাচে–কানাচে এ ভাষণ বাজানো শুরু করে। আমার মনে আছে, আশির দশকের শুরুর দিকে এসএসসি পরীক্ষার পর গ্রামে গিয়ে একটা বাজারে এই ভাষণ বাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা করতে গিয়ে আমি স্বাধীনতা বিরোধীদের রোষানলে পড়েছিলাম। তবে এই ভাষণ থেকে যে অনুপ্রেরণা ও উদ্যমী গতি পেয়েছি তা আমাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য লড়াই করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এক অর্থে আমরা অন্ধকার যুগে দেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
সুতরাং বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বছরের পর বছর জনগণকে, বিশেষ করে বাঙালিকে অনুপ্রাণিত ও উদ্যমী করে তুলবে। ফলে দেশ কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত হবে না। এটি একটি কঠিন পদ্ধতির তুলনায় একটি নরম পদ্ধতির সৌন্দর্য। কঠিন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সময়ের সাথে সাথে বিলীন হয়ে যাবে কিন্তু নরম পদ্ধতিতে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলি কখনই বিলুপ্ত হবে না। তাই এই কিংবদন্তি ও অর্কেস্ট্রেটেড ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাঙালির হৃদয়ে নয়, সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে বছরের পর বছর স্মরণ করা হবে। ইউনেসকো কর্তৃক ৩০ই অক্টোবর ২০১৭–এ এই ভাষণটিকে প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারের ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এটি একটি কারণ।
এখন, আমি অনুপ্রেরণার দিক থেকে এই মহান ভাষণটি বিশ্লেষণ করতে চাই। মহান গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে–ইথোস (Ethos), লোগোস (Logos) এবং প্যাথোস (Pathos) নামে তিনটি প্ররোচনার পদ্ধতি রয়েছে। একটি বক্তৃতার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য এই তিনটি মোড গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইথোস হল বিষয়ের উপর কথা বলার জন্য একজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, লোগোস হল একজনের যৌক্তিক যুক্তি এবং প্যাথোস হল একজন শ্রোতাকে আবেগগতভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা।
শেষ পর্যন্ত, প্ররোচনার তিনটি পদ্ধতি পরস্পর সংযুক্ত। তাই, তারা একে অপরের পরিপূরক। অবশেষে, এই ধরনের পরিপূরক একীকরণ নিয়ে আসে এবং তাই, বিবর্তন। এই ধরনের বিবর্তন একটি সিস্টেমকে তার অগ্রগতির পরবর্তী স্তরে নিয়ে যায়। সেজন্য প্ররোচনার তিনটি পদ্ধতিকে আলাদাভাবে চিন্তা করা উচিত নয়।
বক্তা যদি তাঁর শ্রোতার আগ্রহ, পূর্বধারণা এবং প্রত্যাশাগুলি জানেন তবেই এই জাতীয় উদ্ভাবন একটি বক্তৃতায় ঘটতে পারে। একই সময়ে উদ্ভাবনও নির্ভর করে বক্তার বিশ্বস্ততা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং কর্তৃত্বের উপর। যা ইথোস নামে পরিচিত।
এই ধরনের উদ্ভাবন স্পিকারের যৌক্তিক যুক্তি, এনটেইলমেন্ট এবং চূড়ান্ত ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যা লোগোস নামে পরিচিত। একই সাথে এটি নির্ভর করে বক্তার অনুরণন ক্ষমতার উপর। যার আবেগগত দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রোতাদের বিমোহিত করার ক্ষমতা রয়েছে, যা প্যাথোস নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর জীবনী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি ছিলেন নীতি–নৈতিকতার একজন অনুকরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি একজন কথার মানুষ ছিলেন এবং তাই তাঁকে সর্বদা বিশ্বস্ত মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তদুপরি, তিনি সর্বদা বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হন এবং প্রায় চৌদ্দ বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়ে এই জাতির নেতৃত্বের কর্তৃত্ব অর্জন করেন। বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তাঁকে সর্বদা যৌক্তিক এবং সিদ্ধান্তমূলক হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। তাই লোগোস সম্পর্কিত সমস্ত গুণাবলী তার রয়েছে। তিনি বাঙালির স্বার্থ, তাঁদের পূর্বধারণা এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। সেজন্য তিনি সহজেই মানুষের আবেগ বুঝতে পারতেন। এটি তার প্যাথোসকে চিত্রিত করে।
এটি ছাড়াও, তিনি ইথোস (নীতি), লোগোস এবং প্যাথোসকে আন্তসম্পর্কিত করার ক্ষমতা রাখেন। এ কারণেই, তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা ছিল বিবর্তনীয়র পাশাপাশি উদ্ভাবনী। একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে এই ভাষণের ইথোস (নীতি), লোগোস ও প্যাথোস উপাদানগুলোকে আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি। এই মহান বক্তৃতায় তিনটি প্ররোচনার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক আমরা সহজেই বুঝতে পারি। তাই এই ভাষণটি ছিল অনন্য, বিবর্তনীয় এবং উদ্ভাবনী। এই কারণেই এটি অমর। ফলে এই ভাষণ দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে বছরের পর বছর অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করবে। আমরা প্যাথোস, লোগোস এবং ইথোস সম্পর্কিত তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে কিছু উদ্ধৃতি উদ্ধৃত করতে পারি।
’আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’এটি বক্তৃতার শুরুর অনুচ্ছেদ যেখানে তিনি সভায় উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়েছেন সঠিক তথ্য তুলে ধরে। কারণ, তিনি বাঙালির আশা–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সব সময় যুক্ত ছিলেন।
’আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’
এই অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু বক্তৃতার লোগোস প্রতিফলিত করে। কারণ তিনি প্রাঙ্গণটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তারপরে অ্যারিস্টটলের সিলোজিজমের (ঝুষষড়মরংস) আলোকে শেষ করেছিলেন।
উদাহরণ হল– ’কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন।’ উপসংহারের উদাহরণ হল ‘আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’
’সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’ এই অনুচ্ছেদটি স্পষ্টভাবে তাঁর বক্তৃতার ইথোসকে (নীতিকে) প্রতিফলিত করে কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বস্ত, বিশ্বাসযোগ্য এবং তিনি এই ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখেন। ’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এই বাক্যটিও তাঁর বক্তৃতার ইথোসের অনন্য উদাহরণ। তার বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাকে শোনার জন্য শ্রোতারা সবসময় অপেক্ষা করতেন। তাঁরা তাকে শোনেন এবং প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধু কেঁপে উঠলে দর্শক কাঁপে। অবশেষে, সভার লক্ষ লক্ষ শ্রোতা ঐদিন আশ্বস্ত হলেন। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করল।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।