বইমেলার ব্যাপ্তি সাতদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে প্রকাশক ও লেখক-পাঠকগণ। তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করা হয়েছে এবারের বইমেলা। চলছে মুজিববর্ষ। ১৭ মার্চ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। ফলে ওইদিন পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে বইমেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উৎসব করা হোক।
তবে বইমেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) মাত্র দুদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত তারিখে সমাপনী অনুষ্ঠান করা হবে। বর্ধিত দিনগুলোতে কেবল স্টল চালু রাখা হবে। আজ সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ধিত সময়ের বিষয়টি ঘোষণা করা হতে পারে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে শুরু হয় অমর একুশে বইমেলা। তখন মেলার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ১৯ দিন। ওই হিসেবে মেলা শেষ হওয়ার কথা ১০ মার্চ। এদিকে ঢাকা বইমেলার সময়সীমা ২৮ মার্চ থেকে বাড়িয়ে ১৭ মার্চ পর্যন্ত করা হয়। এরপর চট্টগ্রামেও বইমেলার সময় বাড়ানো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মেলায় অংশ নেয়া প্রকাশকগণ। একই প্রত্যাশা ছিল অন্যদেরও। তবে চসিক এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের পক্ষে ৩৫ জনের স্বাক্ষরে সিটি মেয়র বরাবর বইমেলার সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হয়। এতে বলা হয়, বইমেলা ইতোমধ্যে পাঠক-লেখকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বইমেলা ধীরে ধীরে জমে উঠেছে। বাঙালিকে মুজিববর্ষ পেতে আরো ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ অবস্থায় ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়ে প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের চাওয়া পূরণ করা হোক। স্বাক্ষরকারীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সভাপতি শাহ আলম নিপু, বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী ও কবি রাশেদ রউফ, কবি কামরুল হাসান বাদল, কবি শুকলাল দাশ, সাংবাদিক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, ছড়াকার আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলী, ইকবাল হায়দার ও সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলী প্রয়াস।
আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলী আজাদীকে বলেন, মেলার সময়সীমা অবশ্যই বাড়ানো উচিত। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীকে ঘিরে মেলায় আয়োজন থাকলে নতুন প্রজন্ম জাতির জনক সম্পর্কে জানতে পারবে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে সবার সে চাওয়া পূরণ হবে না। অবাক করা বিষয় জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মা হাতেগোনা দুয়েকজন প্রকাশকও ১৭ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর পক্ষে না।
বলাকা প্রকাশনের জামাল উদ্দিন বলেন, আবেদন করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এখনো কিছু জানায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক লেখক বলেন, কাদের যেন মাঠ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারা অনুষ্ঠান করবে। যাদের দেয়া হয়েছে তারা যদি মুজিবর্ষের কোনো মেলা বা অনুষ্ঠান করে তা বইমেলার মঞ্চে করতে পারে। তাছাড়া জিমনেশিয়ামের ভেতরও প্রচুর জায়গা আছে। সেখানেও করতে পারে। বইমেলার সঙ্গে মিলিয়ে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান হলে সুন্দর দেখাবে।
মেলা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু আজাদীকে বলেন, দুদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ১০ তারিখ সমাপনী অনুষ্ঠান হয়ে যাবে। বাকি দুদিন কোনো আলোচনা সভা হবে না। কেবল স্টল চালু থাকবে। বিষয়টি মেয়র মহোদয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন। ১৭ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, আসলে মেলা জমজমাট হয় শুক্রবার। দুদিন বাড়ালে শুক্র ও শনিবার পাওয়া যাবে। ওইদিক থেকে ঠিক আছে।
বইয়ের কথা : গতকালও মেলায় ভিড় ছিল পাঠকের। তাদের আগ্রহে থাকা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘শাহজাদীর শয্যা’, আনোয়ারা আলমের ‘শিশির থেকে শবনম অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী’, মাহতাব হোসেনের ‘দিলরুবা’, সাদেক সরওয়ার সম্পাদিত ‘কবিতায় এপার ওপার-৭’, তানভীর পিয়ালের ‘সিনেমা দেখার চোখ’, জোনাকী দত্তের ‘বাংলার খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু’, আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলীর ‘ভাইয়েরা আমার’, গোফরান উদ্দীন টিটুর ‘হাসবে বাংলাদেশ’, সৈয়দা ডালিয়ার ‘হলুদ ফুলের দুপুর’, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরার ‘আলোকের ঝরণাধারা’, রহিমা আক্তার উর্শির ‘নবীন ফুলের সৌরভ’ ও শৈবাল বড়ুয়ার ‘ভ্রমণে মেলবন্ধন’।
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘শাহজাদীর শয্যা’য় ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, প্রেম, রহস্য, যৌনতা, খুনের তদন্ত-চারপাশে ঘটে যাওয়া এসব চলমানতার ভেতর থেকে তুলে আনা হয়েছে। মাধুর্যময় গল্পের পটভূমি, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয়েছে মানবিক প্রেমের সৌরভে। টুকরো টুকরো গল্পের বাঁকে ঘটবে এমন বিস্ময়বোধেরই উন্মোচন।
তানভীর পিয়ালের ‘সিনেমা দেখার চোখ’-এ মৌলিক ও অনূদিত রচনা সংকলিত হয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির দশকওয়ারি ইতিহাস নিয়ে রয়েছে আলোচনা। তিনটা সিনেমা নিয়ে আলোচনা আছে। বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতার সাক্ষাৎকার-নির্ভর লেখা রয়েছে। লেখক বলেন, ‘সাক্ষাৎকার-নির্ভর এজন্যই বলছি, এই তিনটির দুটো রচনা কোনো একক সাক্ষাৎকারের অনুবাদ নয়। বরং অনেকগুলো সাক্ষাৎকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে এমনভাবে সাজানো, যা পড়ে মনে হবে নির্মাতা নিজেই প্রবন্ধের আকারে এটি লিখেছেন।
আলোচনা সভা : গতকাল বইমেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত পেশাজীবী সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন পূর্বকোণ লি. এর চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন চৌধুরী। চট্টগ্রাম পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান। প্রধান বক্তা ছিলেন পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী। আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ হারুন, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি অঞ্চল চৌধুরী, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু ও অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু।
জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অসংখ্য মাইলফলক ছুঁয়েছে। তবে কিছু ঘাটতিও রয়েছে, যেগুলো আমাদের স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। এখনই উপযুক্ত সময় নিজেদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখার এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্বপ্নগুলো পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের, যেখানে সব মানুষ স্বাধীনতা ও সমমর্যাদা উপভোগ করবে।