ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

একুশ মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে দৃপ্ত পথে এগিয়ে যাওয়া। একুশের চেতনায় আমরা এগিয়ে চলেছি, একুশের পথ ধরেই এসেছে বাংলার স্বাধীনতা।

মায়ের ভাষা বাংলা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে আন্দোলনে নামে বাংলার দামাল ছেলেরা। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান সালামবরকতরফিকশফিকজব্বার আরও কত নাম নাজানা কত শহীদ। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফিরে পাই আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের মুখের বুলি, মধুর ভাষা বাংলা। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়/ বরকতের রক্ত/ হাজার যুগের সূর্যতাপে/ জ্বলবে এমন লাল যে/ সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/ কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে’।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ বাংলা ভাষার দাবিতে রঞ্জিত হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন মাহবুবউল আলম চৌধুরী। ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের খবর জানতে পারেন তিনি। এরপর অসুস্থ অবস্থাতেই শ্রুতিলিখনের সাহায্য নিয়ে তিনি লিখলেন ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতা। ২২ ফেব্রুয়ারি কোহিনুর প্রেস থেকে প্রকাশিত ১৭ পৃষ্ঠার একটি ছোট্ট বইতে ছাপা হয় কবিতাটি। পাকিস্তানি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কবিতাটি প্রকাশ করেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক। তখন কোহিনুর প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন দবির উদ্দিন। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালালেও পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আগেই কবিতার পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে ফেলেছিলেন প্রেসকর্মীরা। ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ যেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানেওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি/ আজ আমি শোকে বিহ্বল নই/ আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই/ আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল/ যে শিশু আর কোনোদিন তার/ পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার/ সুযোগ পাবে না…’। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানের জনসমুদ্রের সামনে কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুনর রশিদ।

কেবল একুশের প্রথম কবিতা নয়, ভাষা আন্দোলনে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের সূচনাও হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব অর্থাৎ ১৯৪৮ সালেই।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণে ছাত্র হত্যাকাণ্ডের সংবাদ টেলিফোনে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এসময় পুরো চট্টগ্রাম শহর বারুদের মতো ফুটতে থাকে। খবর পাওয়া মাত্রই শহরে একের পর এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এদিন ছাত্রজনতার মিছিল বিভিন্ন দিক থেকে পুরনো ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের দিকে যেতে শুরু করে। এর মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে রেলওয়ে শ্রমিকদের একটি বিশাল মিছিল বের হয়। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম কলেজ এবং মেডিকেল কলেজ থেকে পৃথক মিছিল বের হয়। প্রতিটি মিছিলের স্লোগান ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘ঢাকার গুলিতে হত্যার বিচার চাই’। পরদিন চট্টগ্রাম শহর ছিল আরো উত্তাল। এদিন সকাল থেকেই হাজারো ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে মিছিল করে। অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে রেল যোগাযোগ। এদিন লালদিঘি ময়দানে বিশাল সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন এ কে খান, এম এ আজিজ প্রমুখ। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য কৃষ্ণ গোপাল সেনকে গ্রেপ্তার করে।

চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরী সম্পাদিত ‘সীমান্ত’ পত্রিকা এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক বৈঠক। এছাড়া তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক বইটিও ছিল চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার অন্যতম রূপকার। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবি এবং মুসলিম লীগ সদস্যদের বিরোধিতা এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মতো গর্জে উঠেছিলো চট্টগ্রামের ছাত্রজনতাও।

ভাষাএকটি জাতির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিভাবে পালন করা হয়। আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ও শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশের মানে মাথা নত নয়
পরবর্তী নিবন্ধচিটাগাং চেম্বার ও আইএলও’র ডায়ালগ