প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় আনা হোক সকল শিক্ষার্থীকে

পিংকু দাশ | মঙ্গলবার , ১৫ জুন, ২০২১ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার চূড়ান্ত পরিক্রমায় রয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালীন স্থবির হওয়া অর্থনীতি চাঙ্গা করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। বাজেট হচ্ছে একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে সম্ভাব্য আয় ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব-নিকাশের বিবরণী। অর্থমন্ত্রী এবার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। এটা একদিকে জীবন রক্ষার অন্যদিকে জীবিকা রক্ষার বাজেট। করোনা ভাইরাস মহামারিকালে দেশের দ্বিতীয় বাজেট। বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় ঘাটতির এই পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬.২ শতাংশের মত। এটি বাংলাদেশের ৫০ তম বাজেট। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশে প্রথম ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।
সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কথা মাথায় রেখে এবারের বাজেট প্রণয়ন করেছেন অর্থমন্ত্রী। ‘স্বাস্থ্য ভালো থাকলে দেশ ভালো থাকবে’ -এই ভাবনাকে মাথায় রেখে ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমবারের মত মোট বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ পেয়েছে খাতটি। এই খাতে বরাদ্দ ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে এই বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিতই ছিল। করোনা আক্রান্ত কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় সে লক্ষ্যে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোকে অত্যাধুনিক করা হবে। স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করতে নুতন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রণোদনার এবং মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকদের এককালীন সম্মানী ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমবারের মত সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ এক লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা । সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় দেশের আড়াই কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ১২ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
বাজেটে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো ও ব্যবসা বাণিজ্য গতিশীল করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর,ভ্যাট ও শুল্কে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী পুরুষ উদ্যোক্তাদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকার কম হলে কোন কর দিতে হবে না। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এই সীমা বাড়ানো হয়েছে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত ।
কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে মজবুত খাত। করোনা মোকাবেলায় কৃষি খাতে বরাদ্দ ২৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
বাজেটে অতি ধনীদের জন্য সারচার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নীট সম্পদ ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে ৩৫ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে। আগের অর্থবছরে এই সারচার্জ ছিল ৩০ শতাংশ।
এই অর্থবছরে কৃষি খাত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ,সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতা সমপ্রসারণ, গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে বিনা ও স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ ও সার্বিক মানব সম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানব সক্ষমতা বিনির্মাণে শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি যথাযথ না হয় তাহলে কোন উন্নয়নই টেকসই হবে না। শিক্ষা একটি জাতির দর্পনস্বরুপ। যথাযথ শিক্ষা ছাড়া কৃষি, সেবা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন যে খাতই হোক না কেন সেটার গুণগত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়। শিক্ষা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া ছাড়া শিক্ষাখাত অসম্পূর্ণ।
বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১.৫১ শতাংশের মত। এই বরাদ্দ আগের বছরের চেয়ে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বেশি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা বাজেটের ২০ শতাংশ হলে তা আদর্শ ধরা হয়। কিন্তু এই বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে তা জিডিপির ২.৭৫ শতাংশ মাত্র। গত ১৪ মাসে করোনা বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সব শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সবার বাবা মায়ের স্মার্ট ফোন কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। গত ১৪ মাস ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হলেও অনেক গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবে এই সুবিধা ভোগ করতে পারেনি।
অনেকের স্মার্ট ফোন থাকলেও এম বি কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই সবার জন্য ফ্রি ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা এবং গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ধনী গরীব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য অনেকাংশে দূর হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া, বিশেষ করে নন-এমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিৎ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তা দূর হবে। চলমান করোনা মহামারিতে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব যখন কঠিন সময় পার করছে, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তাঁর সঠিক নির্দেশনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় আমরা মহামারি করোনা মোকাবেলায় সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবো।

লেখক: প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিঠি আর ফুল
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাকালীন শিক্ষার্থীদের অর্জন : হত্যা ও পাশবিকতার কবলে সোনার দেশ