চট্টগ্রামে বাঁশখালীর দক্ষিণ অঞ্চল এবং কক্সবাজার জেলায়ই লবণ শিল্পের একমাত্র কেন্দ্রস্থল। সাতক্ষীরার ঐ দিকে কিছু কিছু লবণ মাঠ হয়ে থাকলেও তা ন্যূনতম। ঐদিকে কড়া লবণ পানির অভাবে লবণ শিল্প বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী দক্ষিণ অঞ্চল এবং কক্সবাজার জেলায় লবণ শিল্পের সাথে প্রায় ৫ লাখ লোক সরাসরি জড়িত। প্রায় ২৫ লাখ নর–নারী এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। জাতীয় অর্থনীতিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ৩০–৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু নানাভাবে প্রতারিত করে বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাকে অপচয় করে শিল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে খাদ্য লবণ আমদানি করা হয়েছে, হচ্ছে। অপরদিকে সরকার চাষীদের থেকে লবণ ক্রয় করে গোদামজাত করে থাকে। কিন্তু তা যথাযথ হচ্ছে না। কতেক আমলা মিল মালিকদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে লবণ আমদানিতে যোগসাজশ রয়েছে বলে শুনা যাচ্ছে।
বিভিন্ন শিল্পের প্রয়োজনে লবণ আমদানির প্রয়োজন হয়। তা কিন্তু খাদ্য লবণ আমদানি নয়, সোডিয়াম সালফেট আমদানি। বিশেষ করে গার্মেন্টসসহ নানান শিল্পের প্রয়োজনে লবণ আমদানিতে ট্যাক্স কম থাকায় অনেক দুর্নীতিবাজ শিল্পপতি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সোডিয়াম সালফেট এর পরিবর্তে খাদ্য লবণ অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করে।
এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার লবণচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি এডভোকেট মুহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, লবণ শিল্প রক্ষায় সরকারের জরুরী পদক্ষেপ আবশ্যক। লবণের মূল্য গত বছর ৬/৭ শত টাকা ছিল এই বছরে সেই লবণের দাম ২৮০ টাকা এর চেয়ে কম। ফলে লবণ চাষীরা আর্থিকভাবে বড় ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে রয়েছে। শিল্প মালিকরা সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করায় লবণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্তের অন্যতম কারণ। সোডিয়াম সালফেট লবণ আমদানির উপর দ্বিগুণের অধিক শুষ্কহার করা আবশ্যক লবণ শিল্প রক্ষার্থে।
অপরদিকে, লবণচাষী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এজেএম গিয়াস উদ্দিন বলেন, লবণের দাম গত বছরের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসার একাধিক কারণের মধ্যে সোডিয়াম সালফেট আমদানির নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করা অন্যতম একটি। এই আমদানিতে ট্যাক্সের হার কম থাকায় তাদের পক্ষে দুর্নীতির মাধ্যমে সোডিয়াম ক্লোরাইড লবণ আমদানি করা সহজ হয়। সাথে মিল মালিকদের সিন্ডিকেট ত আছেই। ফলে লবণের দাম দ্রুত নিম্নমুখী হয়ে যায়।
দেশ লবণের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যাবে, যেহেতু বছর বছর লবণের মাঠের পরিমাণ দ্রুততার সাথে বেড়ে গেছে। জমির মালিকরা ধান বা রবি শস্য উৎপাদনের চেয়ে লবণ উৎপাদন লাভজনক মনে করে ইহা লবণ মাঠে রূপান্তর করে নেয়।
লবণ উৎপাদন অঞ্চলে লবণ চাষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। সেই সময় দেশে তেমন শিল্প কারখানাও ছিল না, লবণের প্রয়োজন হত না। ঘরে রান্না বান্নায় খাওয়ার জন্যই জমির মালিকগণ ধান ও রবি শস্যের পাশাপাশি সাগর বা খাল থেকে লবণ পানি এনে কিছু জমিতে লবণের উৎপাদন করত। জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় লবণের প্রয়োজনও বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে লবণের জমির পরিমাণ।
বিসিক তথা ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন ১৯৬০ সাল থেকে লবণ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, ১৯৬০ সালে এই অঞ্চলে লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭ শত ৭৪ একর। যা বর্তমানে এসে দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৫ শত ৫ একর।
কক্সবাজার বিসিক এর তথ্য মতে বিগত ৩ বছর মূল্যায়ন করলে ২০২২ সালে লবণ মাঠের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ২ শত ৯১ একর। ২০২৩ সালে ৬৬ হাজার ৪ শত ২৪ একর। গত বছর তথা ২০২৪ সালে ৬৮ হাজার ৫ শত ৫ একর। অপরদিকে বিসিক এর তথ্য মতে দেশের লবণের চাহিদার কাছাকাছি দেশে লবণ উৎপাদিত হয়।
লবণ শিল্প তথা খাদ্য লবণ খাতে উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা যাবে; আয় করা যাবে বৈদেশিক মুদ্রা। লবণচাষীরা যদি লবণ বিক্রি করে ন্যায্য দাম না পায় তাহলে যেমনি ২০/৩০ লাখ নর–নারী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি লবণ শিল্প ধ্বংসের দিকে চলে যাবে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। গতমাসে মাননীয় শিল্পপতি আদিলুর রহমান খান কক্সবাজার সফরকালে জোরালোভাবে আশ্বাস দেন, লবণ শিল্প রক্ষায় তিনি জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন।
শিল্পের দিক দিয়ে দেশ দ্রুততার সাথে এগিয়ে যায়; যেমনি গার্মেন্টস শিল্প তেমনি সাধারণ শিল্প। অপরদিকে দ্রুততার সাথে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ফলে লবণের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়। এতে পাল্লা দিয়ে দেশে পতিত জমির পাশাপাশি ধান ও রবি শস্যের জমি লবণ মাঠে পরিণত করতে ব্যাপকতা লাভ করে। ফলে এই শিল্পের লবণচাষীসহ নানাভাবে লাখ লাখ লোক নির্ভরশীল। তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ৩০ লাখ নর–নারী নির্ভর হয়ে ওঠে।
এখানে লবণের দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে শিল্পের জন্য অতি ন্যূনতম ট্যাক্সের লবণ আমদানির পাশাপাশি মিল মালিকদের সিন্ডিকেটদের দায়ী করছে লবণ উৎপাদনকারী শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ। খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরসহ চট্টগ্রাম কক্সবাজারের মিল মালিক সিন্ডিকেট করে উৎপাদিত লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে বলে দোষারূপ করা হচ্ছে। গত ২/৩ বছর যাবৎ লবণের দাম সন্তোষজনক ছিল। চাষীরা উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে খুশিতে ছিল। যেহেতু জমির মালিকের লাগিয়ত প্রদান, পলিথিনসহ লবণ উৎপাদনে আনুষঙ্গিক ব্যয় করার পরেও তাদের হাতে লবণ বিক্রির অবশিষ্ট যা টাকা থাকত তা দিয়ে সারা বছর পরিবার পরিজনের খরচ মিটে যেত। এতে বিসিকের তথ্য মতে গত ৩ বছরে লবণ উৎপাদনের জমি দ্রুত বাড়তে থাকে।
এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় চাষীরা লবণ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন বিধায় লবণ উৎপাদনেও জমির পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকে। কিন্তু চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে ২ মণ প্রতি বস্তায় প্রায় ১৪ শত টাকায় বিক্রি করা হয়। অবাক করা ব্যাপার পরবর্তী দফায় দফায় লবণের দাম কমতে শুরু করে। এতে প্রতি বস্তা ৬–৭ শত টাকাতে এসে দাঁড়ায়। অপরদিকে বস্তা প্রতি ওজনে ১০–১৫ কেজি লবণ অতিরিক্ত দিতে হয়। লবণ চাষীরা বোট দিয়ে লবণ মিলের ঘাটে অসহায়ভাবে দিনের পর দিন অবস্থান করছে লবণ ক্রয় করতে মিল মালিকদের আগ্রহ কমে যাওয়ায়।
বস্তুতঃ লবণ একটি শিল্প। এই শিল্পের সাথে ২০/৩০ লাখ নর–নারীর জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। লবণ উৎপাদন এর জমিও বছর বছর বাড়তে ছিল। এতে সরকারের তথা দেশের কর্ষ্টাজিত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।
লবণ চাষীরা যদি যথাযথ মূল্য না পায় তাহলে উৎপাদনের পরিমাণ যে দ্রুত সংকোচিত হবে তা স্বাভাবিক। এতে দেশের কর্ষ্টাজিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে লবণ আমদানি বাড়িয়ে দিতে হবে।
অতএব যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দেশের বৃহত্তরস্বার্থে লবণচাষীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, ক্ষতিগ্রস্থ না হয় লবণ শিল্প সে লক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট