গত মাস তিনেক আগে চট্টগ্রাম মহানগরীতে এক আয়োজক ওমরাহ যাত্রীদের বিদায় ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। এতে চট্টগ্রামের একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ওমরাহযাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা যখন পবিত্র মক্কায় পৌঁছবেন তখন আপনাদের সকলের উপর হজ্ব ফরজ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আল্লাহ পাক আপনাদের সকলকে হজ্ব করার তাওফীক দিবেন আশা করি। এ কথাটি আরও আগে অন্য এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বক্তব্যেও বলেছিলেন। ইসলাম ধর্ম মতে হজ্ব ফরজ হতে তিন শর্ত রয়েছে। আর্থিক সক্ষতা, শারীরিক সক্ষমতা, যাতায়াত নিরাপত্তা।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান হানাফী মাজহাবের অন্যতম জংশন। প্রায় ৬০/৭০ কোটি মুসলমানের মধ্যে শতকরা ৮০/৯০ জনের অধিক হানাফী মাজহাবের অনুসারী। মুস্তাহাব বিষয়ে মত পার্থক্য থাকলেও হজ্ব বিষয়ে মতানৈক্য নেই।
আমাদের এই অঞ্চল থেকে শতভাগ মানুষ শুধুমাত্র হজ্ব করতে যেত। পৃথকভাবে ওমরাহ করার প্রচলন ছিল না ৩০/৪০ বছর আগেই। হয়ত আর্থিক সচ্ছল বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ হজ্বের অতিরিক্ত ওমরাহ পালন করতে যেতেন। করোনা মহামারীর আগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোটার চেয়ে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা ছিল অত্যধিক। যা পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলের প্রায় ৭২ বছরের ইতিহাসে কোটা অনুপাতে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর পর হজ্বের খরচ প্রায় দ্বিগুণের মত বেড়ে যায়। এই দিকে ওমরাহ গমন হয়ে যায় অতীব সহজতর। সৌদি কর্তৃপক্ষও ওমরাহ যেতে উৎসাহী করছে। ইসলামের ইতিহাসের ১৪৪৪ বছর পর মাত্র ২ বছর আগ থেকে ওমরাহ ইতিহাস বাস্তবতায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ওমরাহ পালনের কথা ছিল কোরআন শরীফ হাদীস শরীফে। বাস্ততা নিরিখে ওমরাহ পালন করতেন হেজাজবাসীরা। যেহেতু হজ্ব করতে পবিত্র মক্কায় পৌঁছতে অতীব কষ্টসাধ্য সেখানে ওমরাহ পালন এর কথা আসছে না। নবী পাক (স.) নবুওয়াত জিন্দেগীতে ৪ বার ওমরাহ পালন করেন বলে স্বীকৃত। অধিকাংশ ধর্মীয় বিজ্ঞজনের মত ওমরাহ করতে পারাটা সুন্নত। অপরদিকে, ঈমানের পর ৪ ফরজের এক ফরজ হল হজ্ব। মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে ওমরাহ পালন নিয়ে উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে তা প্রতিদিন হাজার হাজার নর–নারী ওমরাহ পালনে গমনের দৃশ্য দেখে বুঝা যায়। ফেসবুকে ব্যাপকহারে ওমরাহ পালন এর বিজ্ঞাপন চলছে। এক থেকে সোয়া লাখ টাকার মধ্যে ১৫ দিনের প্যাকেজে ওমরাহ করা যাচ্ছে। এতে যাওয়া–আসা বিমান ভাড়া, দুই পবিত্র নগরীতে থাকা–খাওয়া তথায় যাতায়াত যাবতীয় খরচ অর্ন্তভুক্ত।
অপরদিকে, হজ্ব করতে ন্যূনতম ৬ লাখ টাকা লাগছে। ৩ লাখ টাকা হজ্বের ৬/৭ মাস আগে জমা করতে হয়। স্বভাবতই মানুষের মন মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যেহারে স্রোতের মত ওমরাহ এর উদ্দেশ্যে নর–নারীরা সৌদি আরবে গমন করছে তা অবাক করা ব্যাপার। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় সারা বছর হজ্বের পরিবেশ বিরাজমান। ব্যাপক সমাগম, হোটেলগুলো ভরপুর।
পাকিস্তান আমলে ৭ হাজার বা কম বেশি পুরুষ হজ্ব করত। এই পুরুষের সাথে শতে হয়ত ৫/৭ জন মহিলা থাকত। বাংলাদেশ আমলেও বিগত ২০১৯ সাল পর্যন্ত হজ্বে যেতে হা–হুতাশ বিরাজ করত। যেতে পারবে কিনা, তালিকাভুক্ত হওয়া যাবে কিনা, সিট পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে।
মহান আল্লাহ পাকের মহিমা করোনা মহামারীর পর থেকে হজ্ব ও ওমরাহ এর অবস্থানে আমূল পরিবর্তন এসে যায়। হজ্ব হয়ে যায় বাংলাদেশীদের কাছে বোঝা, চাপ। কোটা পূর্ণ হচ্ছে না। ২০২৩ সালে হজ্বে ৪ হাজার ৪ শতের মত হজ্বের কোটা খালি যায়। গত হজ্বে (২০২৪) প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ তথা ৪৪ হাজার জনের মত কোটা খালি যায়। চলতি সালের কোটাতেও এখনও তিন ভাগের এক ভাগ খালি রয়ে গেছে।
ওমরাহ যাত্রী এত বেড়ে গেছে যে, বাংলাদেশ বিমান সৌদি এয়ারলাইন্স এবং অন্য সস্তা এয়ারলাইন্সগুলো ওমরাহযাত্রীদের সিট দিতে হিমশিম খাচ্ছে। জেদ্দা, পবিত্র মদিনাগামী ফ্লাইটগুলোর সময়ে চট্টগ্রাম–ঢাকা বিমান বন্দরে গেলে মনে হয় হজ্বের পরিবেশ হজ্বযাত্রীর কোলাহল। যেহেতু এহরাম পরিধান করা মানে হজ্ব। ৫ বছর আগেও ওমরাহ এর ক্ষেত্রে এ রকম পরিবেশ ছিল না।
ওমরাহকারীগণের ক্ষেত্রে হজ্বের যে মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা খুবই মারাত্মক। ওমরাহকারীগণ এহরাম পরিধান করে পবিত্র মক্কায় গমন করছে, মাতাফে পবিত্র কাবা তাওয়াফ করছে, সাফা–মারওয়া সায়ী করে মাথার চুল ফেলে দিচ্ছে। কাফেলার গাড়ী করে মিনা–আরাফাত–মুজদালেফা গমন করছে। পবিত্র মদিনায় গিয়ে রওজা পাকে সালাম পেশ করছে। মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ছে ওমরাহকারী দেশে আসার সময় খেজুর, জমজমের পানি নিয়ে আসছে। সাথে করে নিয়ে আসছে ওমরাহ পালন করে হজ্বের আত্মতৃপ্তি। যা খুবই মারাত্মক অনুভূতি। ওমরাহকারী মনে করছেন হজ্বের তৃপ্তি হজ্ব পালনের অনুভূতি তাদের বড় ধরনের ভুল। আর ধর্ম বলছে, ওমরাহকারী পবিত্র মক্কা পৌঁছে গেলে আগে হজ্ব ফরজ না হয়ে থাকলে এখন ফরজ হয়ে গেছে। আমার কাছে অনেকে আসে হজ্ব ও ওমরাহ বিষয়ে পরামর্শ নিতে। আমি সকলকেই বলি চেষ্টা করেন হজ্ব করার জন্য। দেশ থেকে ওমরাহ গমনের ব্যাপকতা লাভ করেছে, মনে হয় দেশে লাখ লাখ ওমরাহকারী যারা হজ্ব করে নাই। ওমরাহকারীদের ভাবতে হবে আমার উপর ত হজ্ব ফরজ হয়ে গেছে সে লক্ষে আমাকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে হা–হুতাশে থাকতে হবে।
সৌদি মুফতিগণ এবং আহলে হাদীস মতাদর্শের ধর্মীয় বিজ্ঞজন এহরাম পরিধান করে পবিত্র মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ পালন করার পর পৃথকভাবে আবার ওমরাহ করার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য নয় বলছে। নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ পালন করে তথায় ২য় বার ওমরাহ পালন করেন নিই। তারা এও বলছে, ওমরাহ পালন করতে মিকাত হয়ে আসতে হবে। আমাদের হানাফী মাজহাব মতে, ওমরাহ পালন বা হজ্বের পর হুদুদে হারামের বাহিরে গিয়ে এহরাম পরিধান করে পুনঃ ওমরাহ করা যাবে। সেই মতে শতকরা ৯০/৯৫ জন মানুষ ওমরাহকারী তানঈমে মসজিদে আয়েশায় গমন করে ওমরাহ এর নিয়ত করছে।
মৌলিকভাবে মিকাত হল ৫টি। পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কার পথে যুলহুলায়ফা। মিশর থেকে আগতদের ঐ দিকে জুহফা। ইয়েমেন থেকে আগতদের ইয়ালামলাম এবং তায়েফের নিকটে দু’টি কারনুল মানাযিল ও জাতে ইরক। কিন্ত আহলে হাদীসের মতে, জুরানা বা জেরানা মিকাত। যা পবিত্র কাবা থেকে পূর্ব দিকে ২০ কি.মি বা কম বেশি দূরত্বে। নবী পাক (স.) অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর হুনাইনে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন জোরানায়। এখানে যাত্রা বিরতি দেন। এখানে এহরাম পরিধান করে পবিত্র মক্কায় আসেন। তবে এখান থেকে কিভাবে পবিত্র মক্কায় আসবেন তা নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। কাজেই হানাফী মাজহাব মতে হুদুদে হারাম আহলে হাদীস মতে মিকাত। সেই হিসাবে তথায় মিকাত লিখা আছে।
বস্তুতঃ বর্তমান কালে যারা হজ্ব করার আগে ওমরাহ করতে যাচ্ছেন তারা যাতে ওমরাহ করে এসে হজ্বের প্রশান্তি অনুভব না করেন। করলে জীবনে বড় ধরনের ভুল হবে। বরং উল্টো ওমরাহ করে এসে হজ্ব করতে যেতে মাথার উপর ধর্মীয় চাপ বেড়ে গেল তা অনুধাবন করতে হবে। হজ্বে যেতে তৎপর হতে হবে, প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা এটা আল্লাহর হাতে। কিন্তু হজ্বে গমনের প্রচেষ্টা থেমে থাকতে পারবে না যেহেতু আপনি ওমরাহ এর নিয়তে পবিত্র মক্কা ঘুরে এসেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট