চট্টগ্রামে শাহ আমানত – ঢাকায় হযরত দায়েম– বানারসে রসূল নোমা
চট্টগ্রাম মহানগরীতে শায়িত রয়েছেন হযরত শাহ আমানত (রহ.)। চট্টগ্রাম আদালতে এক অসহায় ব্যক্তিকে তিনি কারামতের মাধ্যমে দলিল এনে দেয়ার ঘটনা সর্বমহলে প্রচারিত। কিন্তু তাঁর আরেক পরিচিতি হল তিনি মহান শায়খ পীর। তাঁর রয়েছে একাধিক খলিফা তথা প্রতিনিধি। তৎমধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ঢাকা আজিমপুর দায়রা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত সুফি দায়েম (রহ.)।
হযরত দায়েম (রহ.) কর্তৃক পীরের সামনে কারামত প্রকাশ পাওয়ায় হযরত শাহ আমানত (রহ.) চরম অসন্তুষ্ট হন। তরিকতের যাবতীয় কিছু সলব তথা সীস করে নেন। হযরত দায়েম (রহ.) ক্ষমা না পেয়ে নিরাশ হয়ে ঢাকা নবাবপুর লক্ষীবাজার মিয়া সাহেব ময়দান দাদা পীর আবদুল রহিম শহীদের এখানে আসেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের পরামর্শে গঙ্গা নদী হয়ে ভারতের প্রসিদ্ধ শহর বানারস গমন করতে ছিলেন। উদ্দেশ্য খ্যাতিমান অলি রসূল নোমা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেস কাদেরী (রহ)’র সান্নিধ্য লাভ করতে।
বানারস থেকে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত ‘সীরত পীর মুজিব’ বড় গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে ঢাকা থেকে হযরত দায়েম (রহ.) বানারসে হযরত রসূল নোমা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেস কাদেরী (রহ.) কাছে এসেছিলেন। প্রায় শত বছর হায়াত প্রাপ্ত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) বিভিন্ন অলি দরবেশ নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে গেছেন ‘তাযকেরাতুল কেরাম’ নামকরণে। এ গ্রন্থে এবং আজিমপুর থেকে প্রকাশিত ‘আজিমপুর দায়রা শরীফ’ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ে কম বেশি আলোকপাত করা আছে।
হযরত দায়েম (রহ.) দাদা পীরের ভাতিজার পরামর্শে হতাশায় গঙ্গা নদী হয়ে বানারসের পথে ছিলেন। গঙ্গা নদীর তীরে পাটনা শহরে যাত্রা বিরতি দেন বিশ্বখ্যাত অপর অলি হযরত মুনায়েম পাক (রহ.)’র সাক্ষাৎ পেতে। সম্ভবত সকাল বেলা হযরত মুনায়েম পাক (রহ.) এক হাতে আয়না আরেক হাতে কাঁচি নিয়ে দাড়ি ঘোচ কাটতেছিলেন। হযরত দায়েম (রহ.)’র মুখে লম্বা দাড়ি। এতে হযরত দায়েম (রহ.)’র নিকট বাঁকা দৃষ্টি এসে যায়। যারা কামালিয়ত অর্জন করতে পেরেছেন তাঁরা অনেক কিছু বুঝতে পারেন। হযরত মুনায়েম পাক (রহ.)’র তা বুঝতে বাকী রইল না। তিনি তৎক্ষণাৎ আয়নাটি ঘুরিয়ে হযরত দায়েম (রহ.)’র মুখের দিকে ধরেন। সাথে সাথে হযরত দায়েম (রহ.) দেখতে পান তার মুখে কোন দাড়ি নেই, ক্লিন সেভ। এতে হযরত দায়েম (রহ.) হযরত মুনায়েম পাক (রহ.)’র প্রতি অতি আকৃষ্টে থেকে যান দীর্ঘ ১২ বছর।
কিন্তু হযরত মাওলানা আলহাজ্ব সৈয়দ শাহ হেলাল আহমদ কাদেরী রচিত বানারস থেকে ক্রয় করা উর্দু ভাষায় ‘সীরত পীর মুজিব’ গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে ঢাকা থেকে মুহাম্মদ দায়েম (রহ.) হযরত রসূল নোমার কাছে গমন করেন।
হযরত দায়েম (রহ.) ১২ বছর হযরত মুনায়েম পাক (রহ.)’র নিকট থেকে যান। অতঃপর হযরত মুনায়েম পাক (রহ.) এর নির্দেশে হযরত দায়েম (রহ.) চট্টগ্রাম হযরত শাহ আমানত (রহ.)’র কাছে ফিরে আসেন।
হযরত শাহ আমানত (রহ.) হযরত দায়েমকে (রহ.) ক্ষমা করে দেন, প্রতিজ্ঞা প্রত্যাহার করে সংসার জীবনে পা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। লালদীঘি মতান্তরে কর্ণফুলীতে হযরত দায়েম (রহ.) কে ডুব দেয়ান। তিনি আজিমপুর এক পুকুরে উঠে পড়েন। তথায় জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেন। এই হযরত দায়েম (রহ.) হচ্ছেন ঢাকার অন্যতম যেয়ারতগাহ আজিমপুর দায়রা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা। হযরত দায়েম (রহ.) ১২১৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্র হযরত সৈয়দ লাকিত উল্লাহ অসাধারণ কামেল অলি ছিলেন। হযরত নুর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.) ও তাঁর অন্যতম খলিফা রসূলনোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.), হযরত সৈয়দ লাকিত উল্লাহ এর সান্নিধ্যে যাওয়া–আসা করতেন। হযরত লাকিত উল্লাহ (রহ.) ১২৫৩ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
কলকাতার মহানগরীর মানিকতলায় শায়িত রয়েছেন রসূল নোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)। আমরা তরিকতে তাঁর সিলসিলাভুক্ত। ভারতের বানারসে আরেকজন মহান রসূল নোমার কথা জানতে পেরে মন থেকে তাড়িত হচ্ছিলাম কলকাতা থেকে বানারস হয়ে আজমগড় যেতে। যেহেতু মহান আল্লাহর অলিগণের জগতের মধ্যে রসূল নোমা লকবটি ক্ষণজন্মা কয়েকজন সৌভাগ্যবান হতে সক্ষম হন। রসূল নোমা একটি বিশেষ সম্মানিত লকব। এর সরাসরি অর্থ রসূল প্রদর্শক। অর্থাৎ রসূলকে প্রদর্শনকারী। যিনি রসূল (স.) কে দেখাতে পারেন, রসূল (স.) কে দেখানেওয়ালা।
গত বছর নভেম্বর মাসে কলকাতা থেকে বানারস হয়ে আজমগড় গমনের প্রোগ্রাম করা হয়। এতে বানারস শহরে রাত্রিযাপনের প্রোগ্রাম রাখি মহান রসূল নোমা হযরত সৈয়দ ওয়ারেশ কাদেরী (রহ.)’র যেয়ারতে সময় দিতে।
হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (আজমগড়ী হযরত) এর অন্যতম খলিফা আজমগড়ের বাসিন্দা হযরত সাঈদ খান (রহ.) এর সিলসিলার অনেকে বানারস জৈনপুর শাহগঞ্জে রয়েছেন।
আলহাজ্ব এমদাদ উল্লাহ এবারের ভারতের সফর সাথী। ফুরাফুরা বান্ডেলে যেয়ারতে সময় দেয়া হয়। ২১ নভেম্বর সকাল ১০ টার ফ্লাইটে কলকাতা থেকে বানারস গমন করি। খালেদ আনসারী তার তরিকতের ভাই শাকিল আনসারীকে নিয়ে বানারস বিমান বন্দরে স্বাগত জানায়। উভয়ে ব্যবসায়ী, শাকিল আনসারী নিজস্ব কার চালায়। তারা আমাদেরকে নিয়ে বুক করা হোটেলে নিয়ে যায়। তাদেরকে নিয়ে আমাদের হোটেলে যোহরের নামাজের পর দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। অতঃপর রসূল নোমার যেয়ারতে যাই। পুরাতন বানারস শহরে প্রকান্ড মসজিদ সংলগ্ন কয়েকটি কবরের মধ্যে একটি রসূল নোমা হযরত সৈয়দ ওয়ারেস কাদেরী (রহ.)’র। আমরা এই মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে নিয়ে যেয়ারতে সময় দিই। এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত। হযরত রসূল নোমার যেয়ারতে এসে স্থানীয়দের সহযোগিতায় উর্দু ভাষার উপর একটি গ্রন্থ খরিদ করি। যেখানে রসূল নোমা হযরত ওয়ারেস কাদেরীর বর্ণনা রয়েছে।
দেশে এসে গ্রন্থ পর্যালোচনা করে জানা যায় তিনি যৌবনের শুরু থেকে একজন ধর্মীয় উস্তাদ ছিলেন। হযরত রসূল নোমা এলমে হাদীস অর্জন করেছেন সেই যুগের বিখ্যাত ওস্তাদ শেখ হায়াত সিন্ধী থেকে। হযরত রসূল নোমা ছিলেন প্রখ্যাত মুফতি। জনগণের ধর্মীয় সমাধান দিতেন। সেইকালের বড় বড় আলেম সুফি দরবেশগণ তাকে সমীহ করতেন। তিনি ছিলেন শরীয়তের পাশাপাশি মারফত জ্ঞানের ভান্ডার। ধর্মীয় যে কোন আলোচনা মজলিশে তাকে সম্মান দিয়ে সম্বোধন করতেন। সাধারণ মানুষের মাঝে রসূল নোমা হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও তিনি ছিলেন তরিকত জগতের যেমনি জ্ঞানের ভান্ডার তেমনি মারফত জগতের একজন শেখ ছিলেন। তাঁর যে কোন ধর্মীয় সমাধান সকলে বিনা দ্বিধায় মেনে নিতেন। তিনি এলমে তাসাউফের উচ্চ মর্তবার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রায় সময় মোরাকাবায় ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল (স.)’র সান্নিধ্য লাভে সৌভাগ্যবান ছিলেন। যদি কোন মানুষ তাঁকে দেখত তখন পরিপূর্ণ বুজুর্গ হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হতেন। তিনি দ্বীন দুনিয়ার কোন কাজ আল্লাহর রাসূল (স.)’র অনুমতি ছাড়া করতেন না। অনেক মানুষ তাঁর ওসিলায় মদিনা মুনাওয়ারায় যেয়ারত লাভ করেন। তিনি রূহানীভাবে পবিত্র মদিনায় রওজাপাকের সাথে সম্পৃক্ততা থাকেন। তখনকার একজন মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব লিখেছেন, হযরত রসূল নোমা ঘুমানোর সময় লম্বা করে ঘুমাতেন না। দুই হাঁটু বাকা করে ঘুমাতেন এবং খাদেমগণকে উত্তরে বলতেন যে, আমি পা লম্বা করে ঘুমাতে পারি না। কারণ ইহা আল্লাহর রাসূল (স.)’র সাথে বেয়াদবী হবে। পুরো জীবন এভাবে কাটিয়েছেন।
হযরত রসূল নোমা ইলম ও ফজিলতে পরিপূর্ণ ছিলেন। জ্ঞানের সাগর ছিলেন। শরীয়তের মাসালাহ সম্পর্কে অদ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর মুরিদের সংখ্যা অসংখ্য, তৎমধ্যে আলেমের সংখ্যা ব্যাপক।
তাঁর শানে অনেক উপাধি ব্যবহৃত হয়। যেমন সামশুলওলামা, সামশুউদ্দিন, সিরাজুল ফোকাহাহ, কুতবুল আউলিয়া, খলিফায়ে রাসূল ইত্যাদি।
তাঁর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি এশকে রাসূলের বিভোর থাকতেন। নবী পাক (স.)’র সাথে ভালবাসা জ্ঞানের কারণে নয়, বরং ফিতরতেই ছিল। বুঝ শক্তি আসার শুরু থেকেই বয়সের সাথে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে মহান দয়া। নবী পাক (স.)’র প্রতি প্রেমময় কবিতা পড়তেন আবার কখনও নিজের অধৈর্যতাও প্রকাশ পেত। ২ বছর এভাবে অতিবাহিত করেছেন। পরিশেষে বিরহের যন্ত্রণা কেটে গেল। অপেক্ষার ক্ষণ শেষ হল। পৃথিবীকে আলোকিত কারী নবুওয়তের সূর্য নিজের সৌন্দর্য্যতাকে তুলে ধরলেন। জাগ্রত অবস্থায় এভাবে নবী পাক (স.) তার সামনে শুভ আগমন করা এবং নিজেকে তার সামনে প্রদর্শন করে তাকে সফলকাম বানানো তার জন্য। এত বড় সৌভাগ্য ছিল যেটা খুব কম সংখ্যক অলিদেরকে দেয়া হয়।
হযরত ওয়ারেস কাদেরী এ মর্যাদাটা পেয়ে গেলেন যে, দর্শন প্রার্থীদেরকেও নবী পাক (স.)’র যেয়ারত দ্বারা ধন্য করানো। এ মর্যাদাটার নামই রসূল নোমা। এই হতে হযরত মাওলানা সৈয়দ ওয়ারেস কাদেরী নামের পূর্বে রসূল নোমা উপাধি মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত করে।
তাঁর পূর্বে হযরত হাসান রসূল নোমা দেহলভী (১১০৩ হিজরি) অতিবাহিত হয়েছে। তারও এ মর্যাদা অর্জিত হয়েছিল।
এই মহান আশেকে রাসূল রসূল নোমা হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেস কাদেরী ১১৬৬ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। আরও প্রায় ৮০ বছর পর ভারতবর্ষে অপর রসূল নোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র জন্ম হয়। তিনি কলকাতা নগরীতে শায়িত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।